Tuesday, 12 August 2025

বিজ্ঞানময় কোষের মস্তক

 
বিজ্ঞানময় কোষের মস্তক  -  (সন্দর্ভ - সদ্‌গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক প্রত্যক্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত অগ্রলেখ (০২-০৯-২০০৬)
(সন্দর্ভ - সদ্‌গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক প্রত্যক্ষ পত্রিকায়
প্রকাশিত অগ্রলেখ (০২-০৯-২০০৬)

শ্রীমহাগণপতির জন্মকথা থেকে যে তৃতীয় নীতিটি স্পষ্ট হয়, আজ আমরা সেটি দেখব। দ্রব্যশক্তি ও চৈতন্য—এই দুইয়ের এই অতিবৃহৎ বিশ্বে প্রত্যেক জায়গায় অত্যন্ত মহৎ, মঙ্গলময় এবং স্বাভাবিক সংযোগ দেখা যায়। কিন্তু মানুষের মানবীয় জগতে থাকা এই দ্রব্যশক্তির নানা রূপ ও আবিষ্কার এবং সেই মূল শুদ্ধ ও পরমপবিত্র চৈতন্যের নানা প্রকাশের মধ্যে সংযোগ যেমন দেখা যায়, তেমনই মানুষের প্রাপ্ত বুদ্ধির স্বাধীনতা—অর্থাৎ কর্মস্বাধীনতার কারণে সংঘর্ষও দেখা যায়। তবে এই সংঘর্ষ শিব ও শক্তির মধ্যে নয়, বরং তাঁদের অনুগামীদের মানসিকতার মধ্যে—এ কথা বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

(সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু গণেশোৎসবের সময় তাদের বাসস্থান অবস্থিত গণপতির আরাধনা করছেন ...)
(সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু গণেশোৎসবের সময় তাঁর
বাসভবনে স্থিত গণপতির আরাধনা করছেন ...)

দ্রব্যশক্তির একটি রূপ হল মানুষের ভৌত উন্নতিতে সহায়ক বিদ্যার বিজ্ঞানশাখা। বিজ্ঞান—তা সে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা বা জীববিদ্যা হোক—সবসময় মানুষের নানা দিক দিয়ে উন্নতি ঘটিয়েই থাকে এবং সেটিই জগন্মাতার মূল প্রেরণা। কিন্তু যখন জগন্মাতার স্নেহের কারণে এই বিজ্ঞানের বৃদ্ধি হতে থাকে, তখন কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এই ষড়রিপুর বৃদ্ধি করার জন্য মানুষ যখন বিজ্ঞানের ব্যবহার করে, তখন তা জগন্মাতার, অর্থাৎ মহাপ্রজ্ঞার মান্য নয় এমন কাজে পরিণত হয়।

এই জগন্মাতা তাঁর অপরিমেয় স্নেহের কারণে সন্তানের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে তাদের আরও বেশি উন্নতির সুযোগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন সমস্ত ভৌত বিদ্যার ব্যবহার সেই পরমাত্মার সত্য, প্রেম ও আনন্দ—এই ত্রিসূত্রকে ত্যাগ করে হতে থাকে, তখন এই জগন্মাতা তাঁর সন্তানদের সঠিক পথে আনবার জন্য কাজ শুরু করেন। পবিত্রতা ও সত্য থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়ার ফলেই জীবকে অসীম দুঃখ ভোগ করতে হয়—এটি জেনে সেই করুণাময়ী মাতা তখন মাতৃত্বের শাসনপ্রবণ রূপ ধারণ করেন।

একজন সাধারণ মানবী মা-ও ভুল করা, বরং বারবার ভুল আচরণ করা সন্তানের মঙ্গলের জন্যই মুখে বলেন—"আমার কাছে এসো না, আমি তোমার নই, আমার তোমাকে মোটেই ভালো লাগে না", যদিও অন্তরে ভালোবাসা রাখেন এবং উপযুক্ত সময়ে তিরস্কার করেন। তাহলে সর্বজ্ঞ এই বিশ্বমাতা কি তাঁর সন্তানের পতন রোধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবেন?

ভৌত বিজ্ঞানের শক্তির কারণে ঈশ্বরকে ভুলে যাওয়া এবং সেই কারণে উন্মত্ত হয়ে "ঈশ্বরের বিচার আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়"—এই অহংকারে সমস্ত ভৌত বিদ্যা ও কলার ব্যবহার যখন মানুষ অসুরীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য করতে থাকে, তখন বিজ্ঞানের জননী এই মানবীয় ভৌত শক্তিকে নিজের কব্জির উপরকার বাইরের মলের মতো মনে করে দূরে সরিয়ে দেন—তাও আবার সুন্দর ও পরিপুষ্ট রূপে দিয়েই। কেবল তাই নয়, নিজের শুদ্ধির (অর্থাৎ স্নানের) কারণ দেখিয়ে মানুষের দ্বারাই সৃষ্ট ভৌত শক্তিকে নিজের অন্তঃগৃহের দরজা থেকে বাইরে বের করে সেখানে দাঁড় করিয়ে দেন। আর দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই সামান্যতম অহংকার বা অতি অল্প অপবিত্রতাও সহ্য করতে না পারা সেই পরমশিব সেখানে এসে যান। স্বাভাবিকভাবেই মানবীয় অহংকার ও পরমাত্মার অকারণ করুণার সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলে দ্রব্যশক্তির প্রভাবে নিজেকে বলবান মনে করা সেই তামসিক অহংকারের মস্তক ভেঙে দেওয়া হয়।

মাঘী গণেশোৎসবে শ্রীগণেশের অভিষেক
মাঘী গণেশোৎসবে শ্রীগণেশের অভিষেক

কিন্তু যতই কঠোর হয়ে উঠুন না কেন, মায়ের মন ব্যথিত হয়ই, এবং তিনিই সেই বন্ধ দরজা খুলে দৌড়ে বাইরে এসে স্বামীর সাথে সংঘর্ষ করতে প্রস্তুত হন—কারণ জগন্মাতা বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিনাশ চান না, বরং কেবল বিজ্ঞানের তামসিক মস্তকের বিনাশই কাম্য। তিনি চান তাঁর বিজ্ঞানরূপ আদরের সন্তান চিরজীবী হন। দেবগুরু বৃহস্পতি—অর্থাৎ পবিত্রতার সাথে প্রয়োজনীয় সতর্কতা—এই বিশ্বজনীন সতর্কতা শিবশঙ্করকে আদেশ দেন সেই শিশুকে পুনর্জীবিত করতে। এবং সেই সতর্কতাকে গ্রহণ করা পবিত্রতা—অর্থাৎ পরমশিব—সেই শিশুর দেহে গজমুখ যুক্ত করে দেন; কারণ মাতাপার্বতী জন্মের সাথেই সেই শিশুকে ‘অঙ্কুশ’ অস্ত্র দিয়েছিলেন। এই গজমস্তকই হল সমস্ত ভৌত বিদ্যা ও শক্তির ঊর্ধ্বে থাকা বিজ্ঞানের মঙ্গলমূর্তি রূপ। আর এই গজানন আবারও শিব-পার্বতীর কোল জুড়ে আসন গ্রহণ করে।
মানুষের সমস্ত সামর্থ্য ও ক্রিয়াকে তাই এই মহাগণপতিই শুভত্ব, পবিত্রতা ও মাঙ্গল্য প্রদান করতে পারেন।


No comments:

Post a Comment