ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়ির পরিবেশটা ছিল পুরো শুদ্ধ বৈদিক সংস্কারে ভরা, কিন্তু তাতে অনাবশ্যক নিয়ম, জাত-পাত, কিংবা গোঁড়া কর্মকান্ডের ছিটেফোঁটাও ছিল না। মাই (দিদিমার মা) আর দিদিমা সংস্কৃত সাহিত্যে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে সব সংহিতা তাদের মুখস্থ ছিল। তাই বৈদিক মন্ত্রের শুদ্ধ আর ছন্দবদ্ধ উচ্চারণ সবসময় কানে আসত। আজও ওদের দুজনের গলার বৈদিক মন্ত্র আর সূক্তের মিষ্টি সুর আমার হৃদয়ে বেজে ওঠে। গণপতি পূজার পর যে মন্ত্রপুষ্পাঞ্জলি বলা হতো, সেটা আজকালকার ‘শর্টকাট’ মতো ‘ওঁ যজ্ঞেন যজ্ঞময়জন্ত....’ থেকে শুরু না হয়ে, ‘ওঁ গণানাম ত্বা গণপতীম হাবামাহে....’ থেকে শুরু হতো আর প্রায় আধ থেকে পৌনে এক ঘণ্টা ধরে চলত। তার মধ্যে আরোহণ, অবরোহণ, আঘাত, উদ্ধার ইত্যাদি সব নিয়ম মেনেও সেই মন্ত্রপুষ্পাঞ্জলিতে মাধুর্য, কোমলতা আর সহজতা ঠিক তেমনই জীবন্ত থাকত, কারণ সেই মন্ত্রোচ্চারণে শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না, বরং পুরো ভক্তিরসে ভরপুর এক প্রফুল্ল হৃদয় থাকত।
পরে আমার পাঁচ বছর বয়সে, আমার দিদিমার বাড়িতে অর্থাৎ পণ্ডিতদের বাড়িতে গণপতির সামনে ওঁরা দুজনেই আমাকে প্রথম মন্ত্রপুষ্পাঞ্জলির শাস্ত্রীয় পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। তখন আমার মায়ের তিন কাকীমা, মা আর দিদিমা, এই পাঁচজন মিলে আমাকে বরণ করে অনেক মোদক খেতে দিয়েছিলেন। সেই সময় পর্যন্ত আমি আমার দিদিমার বাড়িতে একমাত্র নাতি ছিলাম, আর তাই পুরো পাধ্যে ও পণ্ডিত পরিবারের খুব আদরের ছিলাম। সেই দিনই মাই (দিদিমার মা) আমাকে পাধ্যে পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে বালগণেশের প্রতিস্থাপন পদ্ধতিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আর সেই কারণেই আজও আমাদের বাড়িতে গণেশ চতুর্থীতে যে মূর্তি স্থাপন করা হয়, সেটা বালগণেশেরই হয়।
আমি একবার মাইকে (দিদিমার মা) জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘প্রতি বছর বালগণেশই কেন গো?’ মাই (দিদিমার মা) আমার গালে হাত বুলিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, “আরে বাপুরায়া, শিশু ঘরে এলে আমরা যদি তার যত্ন নিই, তাকে আদর করি, তাহলে সেই শিশুর পেছনে পেছনে তার মা-বাবাও চলে আসেন আর সুখে থাকেন। এই বালগণেশের প্রতি ভক্তদের আদর-যত্নের কারণে পার্বতী মাতা আর পরমশিবেরও আপনা আপনিই স্বাগত ও পূজা হয়ে যায়। আর দ্বিতীয়ত, অচেনা সাধারণ মানুষের ফুটফুটে ছোট বাচ্চার সাথে ব্যবহার করার সময়ও আমাদের মনে আপনা আপনিই এক নিষ্কাম প্রেম প্রকাশ পায়। তাহলে এই অত্যন্ত সুন্দর মঙ্গলমূর্তির বালরূপের সান্নিধ্যে ভক্তদের মনে ভক্তিপ্রেম তেমনই নিষ্কাম ও পবিত্র হবে না কি?”
মাইয়ের (দিদিমার মা) এই অনুভূতিগুলো ছিল এক অত্যন্ত শুদ্ধ ও পবিত্র ভক্তিময় হৃদয়ের সহজ প্রবৃত্তি। আমরা সবাই, আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি মানুষ, গণপতিকে ঘরে বসাই, কেউ দেড় দিনের জন্য তো কেউ দশ দিনের জন্য। বিভিন্ন প্রকারের গণেশ মূর্তি থাকুক না কেন, কিন্তু এই বিঘ্নহন্তা গণেশের সাথে আমরা কি এমন আন্তরিক আর আপন একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করি?
ঘরে আসা গণপতিকে এই ভাবনাতেই কিছু জায়গায় আনা হয় এই ভেবে যে কেবল বাড়ির ঐতিহ্য যেন ভাঙা না হয়, ভাঙলেই বিপদ ঘটবে, কিছু জায়গায় মানত পূরণের জন্য আনা হয়, আবার কিছু জায়গায় শুধু উৎসব ও মজা করার জন্য আনা হয়। এমন গণপতি স্থাপনায় মন্ত্র থাকে, মন্ত্রপুষ্পাঞ্জলি থাকে, আরতি থাকে, মহানৈবেদ্য থাকে এবং রীতিনীতি ও শাস্ত্র পুরোপুরি পালনের ভয়ে দৌড়ঝাঁপও থাকে। কিন্তু এই সব গোলমালের মধ্যে যা হারিয়ে যায়, তা হলো এই আরাধনার মূল সার অর্থাৎ প্রেমময় ভক্তিভাব।
মঙ্গলমূর্তি মোরিয়া ও সুখকর্তা দুঃখহর্তা, এই শ্রীগণপতির উপাধিগুলো সবারই জানা। বরং এই ‘সুখকর্তা দুঃখহর্তা’ উপাধির কারণেই তো আমরা গণপতিকে ঘরে আনতে রাজি হই, কিন্তু ‘মঙ্গলমূর্তি’ এই উপাধির কী হবে? সেই সিদ্ধিবিনায়ক সবকিছু মঙ্গলময় করবেনই, কিন্তু তাকে ঘরে আনার পর আমরা তাকে কতটা মঙ্গলময় পরিবেশে রাখি? এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
শুধু দূর্বার বড় বড় মালা পরিয়ে, একুশটি মোদক সকাল-সন্ধ্যা তার সামনে রেখে, লাল ফুল নিবেদন করে আর আরতির সময় তাল দিয়ে কি আমরা আমাদের মতো করে আর আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাঙ্গল্য তৈরি করি? উত্তর বেশিরভাগ সময়ই ‘না’ হবে।
তাহলে সেই মঙ্গলমূর্তিকে আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ‘মাঙ্গল্য’ আমরা তাকে কিভাবে অর্পণ করতে পারি? উত্তর খুব সহজ আর সরল। সেই মূর্তিকে স্বাগত জানানোর সময় এই ভাবনা রাখুন যে এক বছর পর আপনার প্রিয়জন ঘরে ফিরে আসছে; একুশটি মোদকসহ নৈবেদ্যে ভরা থালা তার সামনে রেখে তাকে আদর করে অনুরোধ করুন, ঘরে আসা অতিথিদের আতিথ্যের আড়ম্বরের চেয়ে সেই গণেশের আরাধনার দিকে বেশি মনোযোগ দিন, আরতি বলার সময় কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবেন না আর প্রধানত এই মহাবিনায়ক যখন তার স্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হন, তখন হৃদয় যেন গদগদ হয়ে ওঠে এবং প্রার্থনা হোক অধিকারভরা ও প্রেমময়, ‘মঙ্গলমূর্তি মোরিয়া, পরের বছর তাড়াতাড়ি এসো।’
অগ্রলেখের শেষে সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু লেখেন -
‘আমার শ্রদ্ধাবান বন্ধুরা, ‘পরের বছর তাড়াতাড়ি এসো’, এই বাক্যটির অর্থ ভালোভাবে বুঝে নিন। আসার তারিখ তো ঠিক করাই থাকে, তাহলে শুধু মুখে ‘তাড়াতাড়ি এসো’ বলার পেছনে কী অর্থ থাকতে পারে? এতে একটাই অর্থ আছে আর তা হলো পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করবেন না, দেব মোরিয়া, আপনি রোজই আসতে থাকুন আর সেটাও তাড়াতাড়িই ঘটুক।’
No comments:
Post a Comment