Friday, 8 August 2025

গজবদন

সদ্‌গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক ‘প্রত্যক্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়(৩১-০৮-২০০৬)

আজ আমরা শ্রীগণেশের জন্মকথা থেকে উঠে আসা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি বুঝে নিতে চাই। শিব মানেই অপবিত্রতার ধ্বংসকারী এক পরমাত্মা। সাধারণ, নিরক্ষর কোনও ভারতীয়ও যখন কোনও ঘৃণিত বা অপবিত্র দৃশ্য দেখে বা শোনে, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে –  “শিব, শিব! এটা কী!” এর পেছনে কোনও ধর্মীয় শিক্ষা না থাকলেও, এটা যেন পরম্পরাগতভাবেই তাদের মধ্যে জন্ম থেকে গেঁথে যায়।

ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে একটি গভীর বিশ্বাস আছে—একজন ব্যক্তি যদি কোনও নারীর উপর অত্যাচার করে এবং তারপর শিবের অভিষেক বা পূজা করে, তাহলে সেই ব্যক্তি তার পাপের কঠিন শাস্তি ভোগ করে। শুধু তাই নয়, এমন ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও যদি শিবের পূজা করেন, তবে তারাও দুর্ভাগ্য বরণ করেন। আরও একটি বিশ্বাস—যারা ১৬ বছরের কমবয়সী শিশুদের উপর নিষ্ঠুরতা করে, তাদের জীবনে শিব কখনো শান্তি, সুস্থতা বা সন্তুষ্টি আসতে দেন না।

এই সব ঐতিহ্যগত বিশ্বাস থেকে যে ভাবটা স্পষ্ট হয় তা হলো—শিব, সেই পরম পবিত্র রূপ, যিনি সর্বদা শুদ্ধতার রক্ষক এবং পাপের নাশক।

তাহলে সেই শিব কীভাবে নিরপরাধ শিশুগণেশের শিরচ্ছেদ করতে পারেন? পারেন না। এই ঘটনা একেবারেই অতিমানসিক স্তরে ঘটে।


শিব যিনি “কর্পূরগৌর”—অর্থাৎ কর্পূরের মতো বিশুদ্ধ—তাঁর সেই নির্মল রূপ অসংখ্য সাধনা আর উপাসনায় জন্ম নেওয়া মন্ত্র ও শ্লোকগুলোর মধ্য দিয়ে আসা মানবিক কুপ্রবৃত্তিকে সহ্য করতে পারছিল না।

যখন দেহশক্তি পার্বতীমাতার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া নানা উপাসনা ও যজ্ঞাদি কর্ম, শিবের প্রকৃত উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে যেতে শুরু করল—অর্থাৎ যখন মানুষ দেবতার নাম ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধির জন্য উপাসনা শুরু করল—তখন স্বাভাবিকভাবেই পরমশিব রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি এইরকম ভ্রান্ত মন্ত্র ও যজ্ঞে থাকা ‘মায়াবীজ’ ধ্বংস করে দিলেন এবং বদলে দিলেন একটি শুদ্ধ উচারণ—"ওঁ"। এরপর থেকে, যেকোনও দেবতার উপাসনার আগে "ওঁ" উচ্চারণ বাধ্যতামূলক হয়ে গেল।

এই “ওঁ”-ই হল সেই গজমুখ, যা শিশুগণেশের ধড়ে বসানো হয়।

বেদেও প্রথমে বিনায়কগণকে বিঘ্নকারক ও বিরক্তিকর হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ ব্রহ্মণস্পতি—অর্থাৎ গণেশের মূল রূপ—তাঁকে দেখা হয়েছে পরম বিশুদ্ধ রূপে। এই দুই রূপের মধ্যে বিরোধ আসলে কোনও বিরোধই নয়—বরং এখানে বলা হয়েছে যে, শাসনহীন বিনায়কগণ অর্থাৎ ‘ওঁ’ ছাড়া উচ্চারিত মন্ত্র বা তন্ত্র, এগুলোই অশুদ্ধ।

এই “ওঁ” প্রতীকের ইতিহাসেও এই কথাটা প্রমাণিত হয়। প্রাচীন লেখনী বা শিলালিপিতে আমরা “ওঁ”-কে যেমন লিখি (ॐ) তেমনভাবে নয়, বরং এইরকম (   ) আঁকা দেখতে পাই।

সন্ত শ্রেষ্ঠ জ্ঞানেশ্বরও এটি খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন—

“ওঁ নমোজি আদ্যা। বেদ প্রতিপাদ্যা।
জয় জয় স্ব-সন্বেদ্যা। আত্মরূপা॥”

সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাবা তাঁর বাড়িতে গণেশোত্সবের সময় গণেশ মূর্তিকে ফুলের মালা দিচ্ছেন।
সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু তাঁর বাড়িতে গণেশোৎসবের সময় গণেশ মূর্তিকে ফুলের মালা পড়াচ্ছেন।

অর্থাৎ এই বিশ্বে প্রথম যে ধ্বনি প্রকাশিত হয়েছিল, সেই ওঁ-কারই হল গণেশের রূপ। তিনিই আত্মরূপ, স্ব-অনুভবের অধিকারী।

শ্রীগণপতি অথর্বশীর্ষ—এটি হলো মহাগণপতির জন্মকথার শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা। “থর্ব” মানে হল চঞ্চলতা, গণ্ডগোল। আর সেই চঞ্চলতা দূর করার যে স্তোত্র—তাই হল অথর্বস্তোত্র। এই অথর্বশীর্ষ হল সব মন্ত্রের মাথা, মস্তক—অর্থাৎ “শীর্ষ”—এবং সেই কারণেই গণপতিই মহামন্ত্র।



এ জন্যেই পার্বতীমাতার গণপতির প্রতি সীমাহীন স্নেহ, আর সেই সূত্র ধরে অনেক গল্পও প্রচলিত আছে। ‘ওঁ’ কোনও অন্যায়কে সমর্থন করে না। ‘ওঁ’ চিরকাল ন্যায়ের পক্ষেই থাকে। আর সেই কারণেই, এই গজবদন, মঙ্গলমূর্তি মহাগণপতিকে নমস্কার না করে কোনও মানবিক কাজ কখনোই শুভ হতে পারে না।

No comments:

Post a Comment