সন্দর্ভ : সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক প্রত্যক্ষের ‘যো মোদকসহস্রেণ যজতি। স বাঞ্ছিতফলং অবাপ্নোতি॥’ এই শিরোনামের সম্পাদকীয় (০৩-০৯-২০০৮)
সন্দর্ভ : সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক প্রত্যক্ষের ‘যো মোদকসহস্রেণ যজতি। স বাঞ্ছিতফলং অবাপ্নোতি॥’ এই শিরোনামের সম্পাদকীয় (০৩-০৯-২০০৮)
 

‘ওঁ গং গণপতয়ে নমঃ। একবার, মাতা পার্বতী শিশু গণেশকে নিয়ে অত্রি-অনসূয়ার আশ্রমে এলেন। নিজের এই নাতিকে দেখামাত্র, মাতা অনসূয়া বাৎসল্য ও আদরে এতটাই ভরে গেলেন যে তিনি বুঝতেই পারছিলেন না যে তিনি কতটা আদর করবেন। তিনি তাকে সীমাহীন আদর করতে লাগলেন। শিশুটি যে কোনো জেদ করত, অনসূয়া তা অবশ্যই পূরণ করতেন।

একদিন, মাতা পার্বতী মাতা অনসূয়াকে বলেছিলেন, 'যদি এই শিশু গণেশের এই ধরনের আদরের অভ্যাস হয়ে যায়, তাহলে কৈলাসে ফিরে গেলে কী হবে?' মাতা অনসূয়া মিষ্টি হেসে বললেন, 'আরে, আমি তোমার স্বামীকেও তো এভাবেই আদর করেছিলাম, তা সত্ত্বেও তিনি কৈলাসে সুখে থাকেন, তাই না?' পার্বতী অনসূয়ার কথা পুরোপুরি মেনে নিলেন।


পার্বতী দেখলেন যে মাতা অনসূয়া যতই আদর করুন না কেন, এই শিশুটি অনসূয়ার কথার বাইরে কখনও যায় না এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে এই আদরের কারণে উদ্ধত হয় না। কিন্তু কৈলাসে থাকলে এই শিশুটির জন্য আমাদের ক্রমাগত চিৎকার করতে হয়। পার্বতী ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর পেলেন না। অবশেষে, একদিন রাতে, শিশু গণেশ ঘুমিয়ে পড়ার পর, তিনি মাতা অনসূয়াকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলেন। মাতা অনসূয়া বললেন, 'আরে, আজ আমি মন্ত্র পাঠে একটু মগ্ন আছি। আমাকে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মন্ত্র জপ সম্পন্ন করতে হবে। সেটা শেষ হলে তারপর দেখা যাবে।'

তার পরের দিনই, স্বয়ং শিবশঙ্কর কৈলাস থেকে তাঁর বাবা-মাকে দেখতে এবং তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এলেন। শিবের ক্রুদ্ধ স্বভাবের কারণে কৈলাসে থাকার সময় সর্বদা একটু সাবধানে চলাফেরা ও কথা বলা পার্বতী, এখন পর্যন্ত অনসূয়ার আশ্রমে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। শিবশঙ্করকে দেখামাত্রই তাঁর মুক্ত ভাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে গেল।

কিন্তু শিবকে আশ্রমের দরজায় দেখামাত্রই মাতা অনসূয়া অত্যন্ত স্নেহের সাথে এগিয়ে গেলেন এবং তাঁর মঙ্গল অভিষ্ট করে এবং তাঁর হাত ধরে তাঁকে ভিতরে নিয়ে এলেন। শিশু গণেশ যে আকুলতায় পার্বতীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, ঠিক সেই একই আকুলতায় শিবকেও মাতা অনসূয়ার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখলেন মাতা পার্বতী। সেই ভোলা শম্ভু সারাদিন আশ্রমের চারপাশে ঘুরতেন, শৈশবের স্মৃতি বলতেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আশ্রমের তাঁর ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে একেবারে ছোট ছেলের মতোই খেলাধুলা করতেন। সেই পরমশিবের বন্ধুরা অবশ্য আর শিশু ছিলেন না। তারাও বড় বড় ঋষি হয়ে গিয়েছিলেন।

সবচেয়ে বড় কথা, এই শিব প্রতিদিন মাতা অনসূয়ার হাতে খাবার খাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। একবার তো এমন সময় এল যে শিশু গণেশ এবং শিব, দুজনেরই একই সময়ে খুব খিদে পেল, দুজনেরই জেদ ছিল যে শুধুমাত্র মাতা অনসূয়াই তাদের খাওয়াবেন। মাতা অনসূয়া শিবকে বললেন, 'এত বড় হয়েছ, একটু থামো, একটু ধৈর্য ধরো। আগে আমি গণপতি বাচ্চাকে খাওয়াব এবং তাঁর পেট ভরে গেলে তারপর তোমারটা দেখব।' শিবশঙ্কর মন খারাপ করে বললেন, 'তোমার কথা আমি মানি কারণ এই শিশুটি আমারও। কিন্তু এটাও মনে হয় যে তুমি আমার চেয়ে তাকেই বেশি ভালোবাসো। কিন্তু তোমার কথা ঠিক, আমি অপেক্ষা করছি।'

শিশু গণেশ খেতে বসলেন। লম্বোদর তো তিনি। তাই তাঁর খিদেও ততটাই বড় ছিল এবং সেদিন গণপতির পেট ভরছিলই না। মাতা অনসূয়া তাকে খাওয়াতে থাকলেন। শিবশঙ্কর পাশে বাইরে থেকে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন, কিন্তু আসলে, তাঁর পালা কখন আসে, সেদিকেই চোখ রেখেছিলেন। মাতা পার্বতীরও অবাক লাগছিল যে তাঁর এই ছেলে আর কত খাবে? আর এই আকুল শিব আর কতক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারবেন? ঠিক তখনই মাতা অনসূয়া শ্রী বালগণপতিকে বললেন, 'আমি তোমার জন্য একটা বিশেষ মিষ্টি খাবার বানিয়েছি, সেটা এখন খাও।' এবং মাতা অনসূয়া সেই শিশু গণেশকে একটি মোদক খাওয়ালেন। সেই মুহূর্তে শিশু গণপতি একটি সুন্দর ঢেকুর তুললেন এবং কী আশ্চর্য! একই সাথে শিবশঙ্করেরও তৃপ্তির ২১টি ঢেকুর এল। শিশু গণপতি এবং শিব একই সাথে মাতা অনসূয়াকে বললেন, 'এই খাবারটা কী অসাধারণ!'


পার্বতী এই ধাঁধা সমাধান করতে পারলেন না। সেই রাতে মাতা পার্বতী আবার মাতা অনসূয়াকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। 'আপনি এই সমস্ত অলৌকিক কাজ কীভাবে করতে পারেন? এত আদর করা সত্ত্বেও এই শিশু গণপতি আপনার সব কথা শোনে! এই ক্রুদ্ধ শিব এখানে আসার সাথে সাথেই একদম নরম স্বভাবের হয়ে যান! শিশু গণেশের খিদে আজ এত বেড়ে গেল! তাঁর খিদে অসংখ্য ও নানা ধরনের খাবার দিয়ে মেটেনি কিন্তু এই একটি ছোট নতুন খাবার দিয়ে শিশু গণেশের পেট এক মুহূর্তে ভরে গেল এবং তাঁর তৃপ্তির ঢেকুর এল! এবং সবার উপরে, ধৈর্য ধরে বসে থাকা এবং ক্ষুধার্ত শিবের পেটও শিশু গণেশ সেই একটি মোদক খাওয়ার সাথে সাথেই সম্পূর্ণরূপে ভরে গেল! শিশু গণেশের একটি ঢেকুরের সাথে শিবশঙ্করের ২১টি ঢেকুর এল!'

এগুলি অত্যন্ত প্রেমময় মাতা পার্বতীর অবাক হওয়ার প্রকাশ ছিল। কিন্তু প্রশ্ন ছিল একটিই যে এর পেছনের রহস্য কী? আর এই অসাধারণ 'মোদক' নামের খাবারটি কী?

মাতা অনসূয়া বললেন, 'এই সব দেখে তোমার যে আশ্চর্য হয়েছে এবং যে প্রশ্নও তোমার মনে এসেছে, তার পেছনের যে কারণ, সেটাই এই সব ঘটনার পেছনের কারণও। তোমার স্বামী ও পুত্রের প্রতি তোমার যে নিরতিশয় ও নিঃস্বার্থ প্রেম আছে, সেই প্রেম - 'লাভেবীণ প্রীতি' (কোনো প্রত্যাশা ছাড়া ভালোবাসা) - এটাই এই সবের পেছনের রহস্য এবং এই মোদক হলো লাভেবীণ প্রীতির, অর্থাৎ নির্মল আনন্দের অন্নময় অর্থাৎ ঘনস্বরূপ। এই শিশু গণেশ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঘনপ্রাণ এবং এই কারণেই এই ঘনপ্রাণকে যখন ঘন অর্থাৎ স্থূলরূপে এই নির্মল আনন্দকে মোদকরূপে খাওয়ানো হলো, তখনই তিনি তৃপ্ত হলেন এবং যা যা স্বার্থোৎপন্ন অর্থাৎ ষড়রিপু-উৎপন্ন, তাকে পোড়ানোর যার কাজ, সেই শিবের তৃপ্তিও কেবল ঘনপ্রাণের একটি মোদক খাওয়ার কারণে হলো এবং সেটাও ২১ গুণ।'

মাতা পার্বতী মাতা অনসূয়াকে প্রণাম করলেন এবং বললেন, 'এই সবই যেন ভক্তিব্রহ্মাণ্ডে চিরকাল থাকে, এমন আশীর্বাদ দিন।' মাতা অনসূয়া বললেন, 'তথাস্তু'।

....এবং সেই দিন থেকে, এই ভাদ্রপদ শুক্ল চতুর্থীর গণেশোৎসব শুরু হলো, গণপতিকে ২১টি মোদকের নৈবেদ্য অর্পণ করা শুরু হলো এবং সেই দিন থেকে, যাকে একবার দিলে শিব ২১ গুণ তৃপ্ত হন, এটা দেখে পরমাত্মার যেকোনো রূপের পূজার শুরুতে শ্রী গণপতির পূজা শুরু হলো।

সম্পাদকীয়ের শেষে সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু লিখছেন - 'আমার প্রিয় শ্রদ্ধাবান বন্ধুরা, মোদক মানে 'লাভেবীণ প্রীতি' এবং এই মোদক শুধুমাত্র গণেশ চতুর্থীর দিনেই নয়, বরং প্রতিদিন অর্পণ করতে থাকো এবং প্রসাদ হিসাবে সেটাই খেতে থাকো। তাহলে বিঘ্ন থাকবেই বা কীভাবে?'

Comments