![]() |
সূত্র- সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু রচিত দৈনিক প্রত্যক্ষে প্রকাশিত সম্পাদকীয় (৩০-০৮-২০০৬) |
গণপতিজির জন্মকথা অধিকাংশ মানুষই জানেন। একবার শ্রীশিবশঙ্কর গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলেন, এবং তিনি কবে গৃহে ফিরবেন, তা মাতা পার্বতী জানতেন না। মাতা পার্বতী তখন অভ্যঙ্গস্নান (তেল ও উবটন প্রয়োগ করে স্নান) করতে চেয়েছিলেন। তিনি শিবজির গণদের (অনুচরদের) স্নানঘরের বাইরে পাহারায় দাঁড় করাতে পারতেন না। তখন তিনি নিজের ডান হাতের কব্জির ত্বকে লাগানো সুগন্ধি লেপ তুলে নিয়ে তার দ্বারা এক সুন্দর বালকের মূর্তি নির্মাণ করলেন এবং নিজের উচ্ছ্বাস (শ্বাসপ্রশ্বাস) দিয়ে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। এই বালকই পার্বতীনন্দন, গৌরীপুত্র বিনায়ক তথা গণপতি।
তারপর মা পার্বতী গণপতিজিকে আদেশ দিলেন যেন তিনি অন্তঃপুরের দরজায় রক্ষীরূপে দাঁড়ান এবং কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে না দেন। তখন পর্যন্ত বালক গণেশ তাঁর জন্মদাত্রী মা পার্বতী ছাড়া আর কাউকে দেখেননি। মা পার্বতী অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন, আর বালগণেশ তার মাতা কর্তৃক দেওয়া পাশ ও অঙ্কুশ এই অস্ত্রসম্ভার নিয়ে তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। এমন সময় শ্রীশিবশঙ্কর তার ধ্যান সম্পূর্ণ করে গৃহে ফিরলেন। স্বাভাবিকভাবেই, শ্রীমহাগণপতি, সেই আট বছরের বালক, তাকে অন্তঃপুরে ঢুকতে বাধা দিলেন। এতে শিবশঙ্কর রুষ্ট হলেন। কিন্তু বালক গণেশ তার ক্রোধকে একেবারেই ভয় না পেয়ে তাঁকে যুদ্ধের আহ্বান জানালেন।
![]() | |
সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর বাড়িতে পালিত গণেশোৎসবে গণপতি |
এই শিব-গণেশ যুদ্ধ যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ততটা ছিল না। ছোট্ট গণেশ নিজের শক্তি প্রদর্শন করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিবশঙ্কর পাশুপত অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, শিবশঙ্করজীর দ্বারা প্রক্ষেপিত পাশুপত অস্ত্র গ্রহণ করে সেই বালগণেশ ঐ যুদ্ধে নিহত হন এবং তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাশুপত অস্ত্রের শব্দ শুনে পার্বতী বাইরে এসে দেখলেন তাঁর সন্তান নিথর হয়ে পড়ে আছে। কিছু সময় আগে গড়ে তোলা গণেশকে এই ভাবে দেখে তিনি অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে পড়লেন। এত ছোট্ট শিশুর সঙ্গে এমন কঠোর ব্যবহার দেখে তিনি শিবশঙ্করকে কঠোর শব্দ দ্বারা নিন্দা করলেন। শিবশঙ্করও এই কাণ্ডে লজ্জিত হলেন।
পার্বতীর মাতৃত্ব তখন রুদ্ররূপ নিল, তিনি ভয়ঙ্কর রণচণ্ডী হয়ে উঠলেন। এই মহা সংঘর্ষে দেবগুরু বৃহস্পতি মধ্যস্থতা করলেন এবং শিবকে আদেশ দিলেন শিশুটির পুনর্জীবন দান করতে। শিব রাজি হলেন (বাল গণেশকে পুর্নজীবিত করার নিশ্চয়তা প্রদান), আর সঙ্গে সঙ্গে পার্বতীর রুদ্ররূপ শান্ত হতে লাগল। শিব তাঁর গণদের বললেন, যে কোনও সদ্যোজাত শিশুর মাথা নিয়ে আসতে। গণরা যে মাথা নিয়ে এল তা ছিল একটি হস্তিশিশুর। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই মাথা শরীরে জুড়ে দিতে না পারলে শিশুটি বাঁচবে না এবং পার্বতী মাতার ক্রোধ সমস্ত বিশ্বকে ধ্বংস করবে এটা বুঝে শিবশঙ্কর তাড়াতাড়ি সেই গজমস্তক গণেশের দেহে সংযুক্ত করলেন। আর শিশুটি আবার জীবন্ত হয়ে উঠল—এইবার সে গজবদন।
এই গল্পটা বহু বছর ধরে ভক্তিভরে শুনে আসা হয়েছে। এখান থেকেই জানা যায় গণেশ গজবদন কেন। এই গল্পটা আবেগের দিক থেকে সত্যি হলেও, এর মধ্যে মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মাহাত্ম্যপূর্ণ তত্ত্ব লুকিয়ে আছে।
![]() |
মাঘী গণেশোৎসবের সময়, ভক্তরা ভালোবাসার সাথে গণেশের পূজা করেন। |
পার্বতী হচ্ছেন এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের দ্রব্যশক্তি—অর্থাৎ উমা। দ্রব্য মানে হল পঞ্চভূতের দ্বারা তৈরি হওয়া প্রত্যেক বস্তু। পার্বতীর সেই সুগন্ধী লেপ—তা হল সেই দ্রব্যের ফলদায়ক গুণ। আর এই গুণই অন্য বস্তুর ওপর প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবই হল ‘ঘনপ্রাণ’। তাই গণেশ হলেন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঘনপ্রাণ।
মানুষের জীবনে শ্বাস, জল আর খাদ্য—এই তিনটি উপাদান জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অত্যাবশ্যক। আমাদের মন, যার ওপর সব কিছু নির্ভর করে, সেটাও গুণের প্রভাবে চলে। ভালো বা খারাপ গুণ - জীবনকে কখনও উন্নতির পথে নিয়ে যায়, আবার কখনও পতনের দিকে। খাদ্য, ঔষধ, মানুষের সংস্পর্শে আসা বিভিন্ন রসায়ন (কেমিক্যাল) অন্যান্য প্রাণী ও জীবজন্তু; এমনকি, সংস্পর্শে আসা অন্যান্য মানুষের ভালো-খারাপ গুণ থেকেও মানুষের জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে আমরা 'বিঘ্ন' বলি।"
মহাগণপতি এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অক্ষয় (অর্থাৎ কখনো শেষ না হওয়া) ও অখণ্ড ঘনপ্রাণ স্বরূপ হয়ে মানুষের উপর বহিরঙ্গ বা অন্তরঙ্গ গুণের বিঘ্নকারক প্রভাবগুলিকে দূর করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। কোনো পদার্থ বা দ্রব্য তার গুণের দ্বারাই কার্যক্ষম হয়, এবং সেই গুণ ও তার প্রভাবকে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা কেবলমাত্র এই গণেশজীরই আছে। তবে তিনি কেবল অনুচিত প্রভাবকে উপযুক্ত প্রভাবে রূপান্তরিত করেন, কখনোই উপযুক্ত প্রভাবকে অনুচিত প্রভাবে রূপান্তরিত করেন না। এই কারণেই মহাগণপতি 'বিঘ্ননাশক' ও 'মঙ্গলমূর্তি' রূপে সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট বন্দনীয়।
মহাগণপতিকে ভক্তি করার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনে উপস্থিত বিভিন্ন দুষ্ট গুণের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং সেই কারণেই সে বিঘ্ন বা বাধাগুলিকেও প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। সন্তশ্রেষ্ঠ রামদাসস্বামী তাঁর মঙ্গলাচরণে বলেছিলেন,
"গণাধীশ যা ঈশ সর্বগুণাচা" —
অর্থাৎ, যিনি গণসমূহের অধিপতি এবং সমস্ত গুণের ঈশ অর্থাৎ ঈশ্বর।
![]() |
সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর বাড়ির শ্রী বাল গণেশ |
No comments:
Post a Comment