সূর্যকোটিসমপ্রভ – ২


 সন্দর্ভ : সদ্‌গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক প্রত্যক্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত অগ্রলেখ (০৫-০৯-২০০৬)

পূর্বের লেখায় আমরা সদ্‌গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ প্রদত্ত ‘অন্ধকাসুর বধ’-এর কাহিনি দেখেছি। এই কাহিনি ভারতবর্ষে প্রচলিত পাঁচটি প্রধান উপাসনা সম্প্রদায়কে একে অপরের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করে। শৈব, দেবীমাতার-উপাসক, বৈষ্ণব, গণপত্য ও সৌর এই পাঁচ সম্প্রদায়ের আদিদেবতাদের সমানভাবে এবং একসঙ্গে আসীন করেই এই কাহিনি দেখায় যে, রং আলাদা হলেও আকাশ কিন্তু একটাই।


এই কাহিনিতে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতেও বহু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের প্রতিপাদন হয়েছে। আজ আমরা তার মধ্য থেকে কয়েকটি তত্ত্ব দেখব। শ্রীমহাদেবের ক্রোধপূর্ণ প্রথম বাক্য থেকে শ্রীবিষ্ণু এক অসুরের “হোয়া” অর্থাৎ কল্পিত ভয় বা ভয় দেখানোর জন্য বানানো পুতুল দাঁড় করালেন। আসলে এটি সত্যিকারের অসুর নয়, বরং মায়ের কথার প্রভাবে তার আদরের সন্তানের মনে ভয় জাগানোর জন্য বানানো এক পুতুল। শিবজীর ক্রোধপূর্ণ বাক্য থেকে শ্রীবিষ্ণু তৈরি করলেন এই অসুররূপী পুতুল অর্থাৎ, এটি হল নিষ্পাপ মানবমনে উদ্ভূত ঈশ্বরের ধাক-ধমক। যেন ভুল কিছু না ঘটে, অর্থাৎ ‘মর্যাদা লঙ্ঘন’ (প্রজ্ঞাপরাধ) না হয় তাই সত্ত্বগুণী বিষ্ণু (যিনি প্রতিটি মানুষের বিবেক হিসেবে বিরাজ করেন) এই ধমক দেন, এবং সেটিও শিবজীর অর্থাৎ পবিত্রতার অনুভূতির প্রকাশের মাধ্যমেই ঘটে।

ভক্তরা সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর বাড়িতে গণেশোৎসবেও স্বয়ম্ভু গণেশের দর্শন নেন
ভক্তরা সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপুর বাড়িতে গণেশোৎসবেও স্বয়ম্ভু গণেশের দর্শন নেন

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিবেক ও পবিত্রতার অনুভূতি থাকে তা সেই মানুষের নিজের পুণ্যের ফল নয়, বরং ঈশ্বরের অকারণ করুণার ফল। কিন্তু কর্ম-স্বাধীনতার ফলে প্রজ্ঞাপরাধ যত বাড়ে, ততই এদের অস্তিত্ব ক্ষীণ হতে থাকে, এবং “প্রজ্ঞাপরাধাত্‌ রোগঃ” এই ন্যায়ে মানুষের জীবনে বিপদ আসে, কিন্তু সেই বিপদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা কমতে থাকে। বালগণেশের এই লীলা থেকে মর্যাদা-রক্ষার একটি তত্ত্ব সুন্দরভাবে সামনে আসে। যেটি এই বিশ্বমাতা (দ্রব্যশক্তি-প্রকৃতি মাতা পার্বতী) মনে করেন শিশুকালে করা উচিত নয়, সেই সীমারেখা মানা এটি উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয়। শ্রীমহাগণপতি তাঁর এই লীলার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, শ্রেষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠ আপনজনের বাক্যের মর্যাদা লঙ্ঘন কখনই শোভনীয় নয়। এমন মর্যাদাভঙ্গের কথা ভাবলেই মনে ভয়ের “হোয়া” দাঁড়ায়। আর সেই ভাবনা যদি কাজে রূপ নেয়, তবে কি সত্যিকারের অসুর জন্ম নেবে না? প্রত্যেক মানুষকে নিজের বয়স, নিজের শারীরিক ও মানসিক শক্তি, নিজের কর্তব্য ও দায়িত্ব এইগুলির অবস্থা উপলব্ধি করেই যে কোনো কাজ হাতে নেওয়া উচিত।


শ্রীবিষ্ণু ও জগন্মাতা পার্বতী কর্তৃক গৃহীত এই যথাযথ ব্যবস্থা-পরিকল্পনার ফলে শিবজি বালগণেশকে (বালগণেশের) মায়ের কাছে সমর্পণ করে নিজের কাজে যাত্রা করেন অর্থাৎ, যখন মানুষের মন বিবেকের সাহায্যে ভৌতিক শক্তির সীমা চিনে ফেলে, তখন অন্তরে বিরাজমান পবিত্রতার অনুভূতি জগৎজুড়ে নিজের অসুর-বিনাশী কার্যক্রম চালিয়ে যায়। মর্যাদা রক্ষা হলেই অন্তরের পবিত্রতার অনুভূতি ও শক্তি দুটোই একসঙ্গে বাড়তে থাকে এবং তখন মন ও জীবনে বিরাজমান অসুরদের বিনাশ অবধারিত হয়।

মাঘী গণেশোৎসবে শ্রী ব্রাহ্মণস্পতির পূজা ও চিকিৎসা দেওয়ার সময় সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু
মাঘী গণেশোৎসবে শ্রী ব্রাহ্মণস্পতির পূজা ও চিকিৎসা দেওয়ার সময় সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু

পরে বালগণেশ নিজের মনে জন্মানো সেই ভয়কে থুতু দিয়ে ফেলে দেন এবং সেই থুতু থেকেই ভয়ঙ্কর, ক্রমাগত-বর্ধনশীল ‘অন্ধকাসুর’-এর সৃষ্টি হয়। মানুষ যখন কোনও চাপের কারণে মর্যাদা রক্ষা করে, তখন কিছুদিন পর সেই চাপকে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হয়। এখানে যে চাপ প্রয়োজনীয় (Expected), সেটি হল ঈশ্বরের নিয়মের ধমক। কিন্তু যখন মানুষের কাছে সেই ধমক অস্বস্তিকর মনে হয়, তখন একসময় মন বিবেক থেকে সরে গিয়ে সেটিকে ফেলে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই, সেই স্থানে বিকৃত অহংকার ও উদ্ধততা এসে বসে এটাই অন্ধকার, এটাই অন্ধকাসুর।


এই অন্ধকাসুর একবার জন্ম নিলে ক্রমশ বাড়তেই থাকে। “আমি যা-ই করি, ঈশ্বর কিছুই করতে পারবে না” এই প্রবৃত্তিই আসলে অন্ধকার-অন্ধকাসুর। কিন্তু সশরীরে পবিত্রতার প্রতীক শিবজি ও কর্মশক্তি (দ্রব্যশক্তি) পার্বতীমাতার পুত্র দ্ৰব্যগুণসমৃদ্ধ সত্ত্বগুণশালী শ্রীমহাগণপতি, তিনি বয়সে ছোট হলেও এই অন্ধকাসুরকে সমূলে বিনাশ করতে সক্ষম। এই দ্রব্যগুণসমৃদ্ধ সত্ত্বগুণের লড়াইয়ে ভাবগুণসমৃদ্ধ সত্ত্বগুণশালী শ্রীবিষ্ণু সহায়তা করেন। মুহূর্তে সেই সত্ত্বগুণের তেজ সূর্যকোটির সমান জ্বলজ্বল করতে থাকে আর তারপর কী হয়? বালগণেশ সহজেই অন্ধকাসুরকে বিনাশ করেন। ভাবগুণসমৃদ্ধ সত্ত্বগুণ এটাই ভক্তির প্রভাব।


অগ্রলেখের সমাপ্তিতে সদ্‌গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু লিখেছেন 


 “বন্ধুরা, প্রত্যেকের জীবনের কোনও না কোনও মোড়ে এই অন্ধকাসুর বারবার এসে হাজির হয়। কিন্তু সেই মঙ্গলমূর্তি মহাগণপতির আরাধনা এবং নিজের ইষ্টদেবতার ভক্তি তোমাকে সেই মোড় থেকে আস্তে করে আলোকময় পথে নিয়ে যেতে পারে।”

 
গণপতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে? ব্যাখ্যা করেন অনিরুদ্ধ বাপু

Comments