সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ তুলসীপত্র ৬৯৫ - এ এই অগ্রলেখটিতে মানুষের জীবনের ১০টি কালের কথা বলেছেন।এর মধ্যে ৯ম কালের ব্যাখ্যা তুলসীপত্র ৭০২ অগ্রলেখ থেকে শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে অগ্রলেখগুলিতে কিরাতকাল ও কিরাতরুদ্রকে ব্যাখ্যা করার সময় সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ মূলার্ক গণেশ ও নবদুর্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন।
সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু তুলসীপত্র-১৩৭৭ এই অগ্রলেখে লেখেন,
সত্যযুগের চারটি চরণ হয় এবং সেই চারটি চরণই সমান সময়ের হয়।
সত্যযুগের প্রথম চরণ শেষ হওয়ার সময় দেবর্ষি নারদ সমস্ত ব্রহ্মর্ষিদের পরিষদ ডাকলেন এবং ‘পরবর্তী চরণের জন্য কী করা প্রয়োজন’ এই বিষয়ে গভীর আলোচনা করলেন। তাঁদের সভায় কিছু সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তাঁদের সকলকে নিয়ে দেবর্ষি নারদ অত্রি ঋষির সঙ্গে দেখা করলেন।
সেই সময় অত্রি ঋষি শান্তভাবে নৈমিষারণ্য রচনায় মগ্ন ছিলেন। দেবর্ষি নারদ ও সমস্ত ব্রহ্মর্ষিকে দেখতে পেয়ে অত্রি ঋষি তাঁর চিরন্তন শান্ত, স্থির ও গম্ভীর স্বভাব অনুসারে তাঁদের সকলকে প্রশ্ন করলেন, “হে প্রিয়জনেরা! আপনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এসেছেন, তা আপনাদের মুখের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এবং আপনারা সকলে মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বত্র বিচরণ করে থাকেন, তা আমি জানি। আপনাদের মধ্যে স্বার্থের লেশমাত্র নেই, সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত এবং সেই কারণে মানবকল্যাণের বিষয়ে আপনাদের যদি কিছু প্রশ্ন করার থাকে তবে আমি আপনাদের অনুমতি দিচ্ছি।
![]() |
শ্রী অনিরূদ্ধ গুরুক্ষেত্রমে বিরাজিত শ্রীমূলার্ক গণেশের স্থাপনার কালে ঘটিত যজ্ঞ দর্শনের সময় শ্রী অনিরূদ্ধ বাপু |
কিন্তু আমি বর্তমানে এই পবিত্র নৈমিষারণ্যের রচনায় মগ্ন আছি এবং এই স্থানটিকে শম্বলা নগরীর সাথে যুক্ত করতেও ব্যস্ত আছি। এই কারণে আমি কারোর প্রশ্নের উত্তর মুখ দিয়ে বা লিখে দেবো না, এমন সংকল্প করেছি।
অতএব হে প্রিয়জনেরা! আমি আপনাদের সকলকে মন থেকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনারা আমাকে যেকোনো সময় যত খুশি প্রশ্ন করতে পারেন। তবে আমি আপনাদের উত্তর আমার কাজের মাধ্যমেই দেবো।”
অত্রি ঋষির এই কথাগুলি শুনে দেবর্ষি নারদ সহ সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা বুঝতে পারলেন যে তাঁদের প্রশ্নগুলি এই আদিপিতা অর্থাৎ ভগবান অত্রির কাছে আগেই পৌছে গেছে। কারণ তাঁদের সকলের মনে একটাই প্রশ্ন ছিল - যে ‘এই কল্পের সত্যযুগের প্রথম চরণের শেষেই মানুষ কর্মের দিক থেকে এতো দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাহলে ত্রেতাযুগ ও দ্বাপরযুগে কী হবে? আর এর জন্য আমাদের কী করা উচিত?’
তাঁরা সকলে ভগবান অত্রির আশ্রমে থাকতে লাগলেন। আদিমাতা অনসূয়া অবশ্য সেখানে ছিলেন না। তিনি অত্রি ঋষির গুরুকুল সামলাচ্ছিলেন, সমস্ত ঋষি পত্নীদের বিভিন্ন বিষয় এবং পদ্ধতি বোঝাচ্ছিলেন এবং সেই আশ্রমটি নৈমিষারণ্য থেকে অনেক দূরে ছিল।
সন্ধ্যা পর্যন্ত অত্রি ঋষি কেবল সমিধা সংগ্রহ করেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি প্রতিটি সমিধাকে খুব সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করেই বেছে নিচ্ছিলেন। সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা বারবার অত্রি ঋষিকে অনুরোধ করলেন, “হে ভগবান! এই কাজটি আমরা করব।” কিন্তু ভগবান অত্রি কেবল ঘাড় নেড়েই না করে দিলেন।
সূর্যাস্তের পর অত্রি ঋষি সকলের সাথে আশ্রমে ফিরে এলেন এবং তারপর ভোজনের পর অত্রি ঋষি স্বয়ং সমিধার বিভিন্ন প্রকার বিভাজন করতে লাগলেন - বৃক্ষ অনুযায়ী, দৈর্ঘ্য অনুযায়ী, আর্দ্রতা অনুযায়ী এবং গন্ধ অনুযায়ী।
এই ভাবে সমস্ত সমিধার ভালোভাবে শ্রেণীবিভাগ করে তিনি বিভিন্ন সমিধার ছোট ছোট গোছা বিভিন্ন পাত্রে রাখলেন।
তাঁদের সকলের মনে হল যে এবার অত্রি ঋষি বিশ্রাম করবেন। কিন্তু তখনই অত্রি ঋষি পলাশ গাছের পাতা নিয়ে সেগুলি দিয়ে পত্তল (পাতার তৈরি থালার মতো পাত্র যা থালার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়) এবং দ্রোণ তৈরি করতে লাগলেন।
এই সময়ও তাঁদের সকলের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে অত্রি ঋষি নিজে একাই পত্তল ও দ্রোণ তৈরি করতে লাগলেন।
অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি পাতাগুলি নির্বাচন করছিলেন এবং অত্যন্ত সুন্দর ধারযুক্ত পত্তল ও দ্রোণ তৈরি করছিলেন।
দেবর্ষি নারদ সমস্ত ব্রহ্মর্ষিদের চোখ দিয়ে ইশারা করলেন - ‘দেখুন! একটি পাতাতেও ছোট ছিদ্র নেই বা একটিও পাতা একটুও ছেঁড়া নয়।
পত্তল ও দ্রোণ বানানো হয়ে গেলে অত্রি ঋষি সেই সব জিনিস একটি খালি কুলুঙ্গিতে (ঘরের দেওয়ালে তৈরি করা স্থান বিশেষ) রেখে দিলেন এবং সেই ব্রহ্মর্ষিদের বললেন, “তোমাদের আমাকে সাহায্য করার ইচ্ছা আছে তো! তাহলে আগামীকালের মধ্যে এই সমস্ত টাটকা সবুজ পলাশপাতার পত্তল ও দ্রোণ রোদে শুকানোর কাজটি করো।” এই কথা বলে ভগবান অত্রি ঋষি তাঁর ধ্যানের জন্য ধ্যানকুঠিতে চলে গেলেন।
পরের দিন সমস্ত ব্রহ্মর্ষি নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে তাঁদের নিজেদের সাধনা পূর্ণ করে, সূর্যোদয় থেকে তাঁদের কাজে লেগে পড়লেন। অত্যন্ত তন্ময়তার সাথে প্রতিটি ব্রহ্মর্ষি তাঁদের নিজেদের কাজ করছিলেন। সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত সেই সমস্ত পত্তল ও দ্রোণ ভালোভাবে শুকিয়ে গিয়েছিল এবং ওর মধ্যে জলের কোনো অংশ মাত্র ছিল না।
সূর্যাস্তের সময় অত্রি ঋষি আশ্রমে ফিরে আসতেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা শিশুর মতো আনন্দে সেই সমস্ত পত্তল ও দ্রোণ কীভাবে ভালোভাবে শুকিয়েছে, তা অত্রি ঋষিকে দেখালেন।
অত্রি ঋষি তাঁদের পরিশ্রমের প্রশংসা করলেন এবং তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “এগুলির মধ্যে থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়া পত্তল ও দ্রোণ কোনগুলি? মধ্যাহ্ন থেকে দুপুর পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়া কোনগুলি? আর যেগুলি শুকোতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় লেগেছে, সেগুলি কোনগুলি?”
এবার সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তাঁরা এই ধরনের পর্যবেক্ষণ করেননি এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এটি জেনে নেওয়া ভগবান অত্রির সামনে ভুল হত।
এই কারণে সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা লজ্জিত হয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করলেন।
তখন অত্রি ঋষি জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু এমনটা কীভাবে হল? আপনারা তো এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব ভালোভাবে জানেন।”
কারোর কাছেই এর উত্তর ছিল না।
বাপু তুলসীপত্র-১৩৭৮-এ আরও লিখেছেন যে,
মনে মনে লজ্জিত সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিদের দিকে অত্যন্ত সৌজন্যের সঙ্গে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অত্রি ঋষি বললেন, “পুত্রগণ! অপরাধী হওয়ার অনুভূতি ত্যাগ করুন।
কারণ নিজের ভুলের জন্য অপরাধবোধ তৈরি হলে ধীরে ধীরে অনুশোচনা (আফসোস) হয় এবং এই অনুশোচনা ক্রমাগত মনে বিঁধতে থাকলে তা বিষাদে রূপান্তরিত হয় অথবা হীনমন্যতায় (ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স) পরিবর্তিত হয় এবং এটি তো আরও ভুল।
আজ আপনারা পলাশ গাছের পাতা সংগ্রহ করুন, আপনারাই পত্তল ও দ্রোণ বানান এবং আপনারাই কাল সেগুলিকে শুকোতে রাখুন এবং তখন পর্যবেক্ষণ করতে ভুলবেন না।
![]() |
শ্রদ্ধাবান ভক্তবৃন্দ শ্রী অনিরূদ্ধ গুরুক্ষেত্রমে বিরাজিত শ্রীমূলার্ক গণপতির দর্শণ নিচ্ছেন |
আমি আমার ধ্যানের জন্য অন্তকুঠিতে যাচ্ছি এবং কাল সূর্যাস্তের সময়ই আমি বাইরে আসব। সেই সময় সমস্ত কাজ শেষ করে প্রস্তুত থাকবেন।”
সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা অত্যন্ত চিন্তাভাবনা করে এবং উৎসাহের সাথে তাঁদের কাজে লেগে গেলেন। তাঁরা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সমস্ত কাজ অত্রি ঋষির আদেশ অনুসারে করে পরের দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভালোভাবে সাজিয়ে রাখলেন।
কেবলমাত্র দেবর্ষি নারদ অবশ্য কোনো কাজ করেননি। তিনি কেবল সেই প্রতিটি ব্রহ্মর্ষির সঙ্গে ঘুরছিলেন।
অত্রি ঋষি ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর ধ্যানকুঠি থেকে বাইরে এলেন এবং তিনি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিদের দিকে তাকালেন এবং তার সঙ্গে প্রতিটি ব্রহ্মর্ষি এগিয়ে এসে তাঁদের নিজেদের নিজেদের কাজ দেখালেন।
প্রত্যেকের কাজ খুবই সুন্দর হয়েছিল এবং তাঁরা শুকিয়ে যাওয়া পাতাগুলির শ্রেণীবিভাগও ভালোভাবে করতে সফল হয়েছিলেন।
কিন্তু তবুও অত্রি ঋষির মুখে কোনো সন্তোষ দেখা যাচ্ছিল না। এখন তাঁকে প্রশ্ন করার সাহস কোনো ব্রহ্মর্ষির হচ্ছিল না। কারণ অন্যান্য সমস্ত ব্রহ্মর্ষি নির্মিত (নির্মান করা হয়েছিল) ছিলেন, আর ভগবান অত্রি স্বয়ম্ভূ ছিলেন - আদিশক্তির পুরুষরূপ ছিলেন।
অত্রি ঋষি: “হে মিত্রগণ! কেবল দেবর্ষি নারদই সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ করেছেন। আপনাদের সকলের কাজ শুধু একশো গুণের (মার্কস) মধ্যে ১০০ গুণ হয়েছে, ১০৮ গুণ হয়নি।”
এবার তো সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা আরও বেশি হতভম্ব হয়ে পড়লেন। ‘দেবর্ষি নারদ তো একটিও পলাশপাতা সংগ্রহ করেননি, একটিও দ্রোণ বা পত্তল বানাননি। তাহলে এটা কীভাবে হল?' এই চিন্তা তাঁদের প্রত্যেকের মনে আসছিল।
![]() |
শ্রী অনিরূদ্ধ গুরুক্ষেত্রমে বিরাজিত শ্রীমূলার্ক গণপতি |
কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে ভগবান অত্রি কখনও মিথ্যা কথা বলবেন না, পক্ষপাত করবেন না অথবা তাঁদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বাস্তবতা পরিবর্তন করে উপস্থাপন করবেন না।
তখনই সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা বুঝতে পারলেন যে আশ্রমের বাইরে তাঁদের সকলের প্রধান ঋষি শিষ্যরা এসেছেন - যাঁদের মধ্যে কিছু মহর্ষি আছেন, কিছু তপস্বী ঋষি আছেন, কিছু নতুন ঋষি আছেন এবং কিছু ঋষিকুমারও আছেন।
এখন অত্রি ঋষি তাঁদের সকলকে আবার দু'দিন সেই কাজ তাঁদের নিজেদের শিষ্যদের দিয়ে করিয়ে নেওয়ার আদেশ দিলেন এবং বললেন, “এইবার আপনারা আপনাদের প্রতিটি শিষ্যের তার কাজ অনুযায়ী গুণ নির্ধারণ করবেন এবং আমি আপনাদের।”
সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা তাঁদের নিজেদের শিষ্যদের অত্রি ঋষির আদেশ বুঝিয়ে বললেন এবং তাঁরা নিজেরা প্রতিটি শিষ্যের কাজের সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
দু'দিন পর অত্রি ঋষি আবার সেই সময়েই বাইরে এলেন এবং তার সাথে প্রতিটি ব্রহ্মর্ষি নিজেদের নিজেদের শিষ্যের কাজ অত্রি ঋষিকে দেখিয়ে, তার সাথে তাঁদের প্রত্যেকের পাওয়া একশো গুণের মধ্যে প্রাপ্ত গুণ সম্পর্কে বললেন।
এরপরে ভগবান অত্রি ব্রহ্মর্ষিদের সমস্ত শিষ্যদের তাঁদের নিজেদের নিজেদের নিবাসে চলে যেতে বললেন।
সেই সমস্ত মহর্ষি ও ঋষিরা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর, সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা অত্যন্ত বাল্যভাবের সঙ্গে অত্রি ঋষির দিকে অত্যন্ত আগ্রহ এবং কৌতুহলের সঙ্গে তাকালেন।
অত্রি ঋষি তাঁদের সকলকে অনেক অনেক আশীর্বাদ দিয়ে বলতে লাগলেন, “প্রিয় আপনজনেরা! আপনাদের এমনকি ‘মহর্ষি’ শিষ্যরাও ১০০ এর মধ্যে ১০০ গুণ পাননি। এর কারণ কী?”
সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা অনেক চিন্তা করলেন। কিন্তু তাঁরা উত্তর খুঁজে পেলেন না এবং উত্তর খুঁজতে তাঁদের কাছে থাকা সিদ্ধি অত্রি আশ্রমে ব্যবহার করতে পারতেন না। এই কারণে তাঁরা সকলে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে প্রণাম করে ভগবান অত্রিকে বললেন, “আমরা এর পেছনের কারণ জানতে পারছি না।
আমাদের নিজেদেরও ১০০ এর মধ্যে ১০৮ গুণের প্রাপ্তি ঘটে নি এবং আমাদের শিষ্যদেরও তো ১০০ গুণ প্রাপ্তি ঘটে নি। আমাদের বুদ্ধি স্থবির হয়ে গেছে।
হে দেবর্ষি নারদ! আপনারই ১০০ এর মধ্যে ১০৮ গুণ প্রাপ্ত হয়েছে। অন্তত আপনিই দয়া করে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিন।”
![]() |
শ্রী অনিরূদ্ধ গুরুক্ষেত্রমে বিরাজিত মূলার্কগণেশের স্থাপনার সময় কৃত যজ্ঞ |
দেবর্ষি নারদ স্পষ্ট কথায় বললেন, “ভগবান অত্রির কথাকে লঙ্ঘন করা আমার পক্ষেও সম্ভব নয় এবং ভগবান অত্রির কৃপা ও অনুগ্রহের উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তাই তিনি যা করবেন তা তিনি নিজেই করবেন।”
ভগবান অত্রি তৎক্ষণাৎ আদিমাতা অনসূয়ার স্মরণ করলেন এবং তখন এক মুহূর্তে অত্রি ঋষির পাশে আদিমাতা অনসূয়াকে দেখা যেতে লাগল।
সেই স্নেহময়ী আদিমাতাকে দেখে সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা ক্রন্দন করতে শুরু করলেন। তিনি তো আদিমাতা ছিলেন! তাঁর হৃদয় বিচলিত হয়ে উঠল এবং তিনি তৎক্ষণাৎ শ্রীবিদ্যাপুত্র ত্রিবিক্রমকে সেখানে ডাকলেন।
বাপু তুলসীপত্র-১৩৭৯-এ আরও লিখেছেন যে,
আদিমাতা অনসূয়ার আদেশ অনুসারে ভগবান ত্রিবিক্রম সেই আশ্রমে এসে সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিদের সাথে কথা বলতে লাগলেন, “হে মিত্রগণ! আপনারা সমস্ত ব্রহ্মর্ষি আমার অত্যন্ত নিকটবর্তী আপনজন এবং আপনাদের প্রত্যেকের ক্ষমতা, কার্যক্ষমতা ও জ্ঞান অপরিমেয়।
কিন্তু এই মুহূর্তে আপনারা সকলে ‘আমরা কোথাও কম পড়ে গেছি’ এই ভাবনায় আটকে আছেন।
ভগবান অত্রিকে আপনারা যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে এখানে এসেছেন - ‘এই কল্পে সত্যযুগের প্রথম চরণের পর থেকেই মানবসমাজ অকার্যকর এবং দুর্বল হতে শুরু করেছে, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে?’ - এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই ভগবান অত্রি এই সমস্ত লীলা ঘটিয়েছেন।
আপনারা কী, এমনকি আমি এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হনুমন্ত ও শ্রীদত্তাত্রেয়ও অত্রি-অনসূয়ার সামনে শিশুবৎ থাকি
এবং ঠিক এই কথাটাই আপনারা সকলে ভুলে যাচ্ছেন এবং সেই কারণে আপনারা গুণ (মার্কস) কম পাওয়ায় লজ্জিত হয়েছেন। এমনটা হওয়ার কোনো কারণ নেই; কারণ ব্রহ্মর্ষি অগস্ত্য আলাদা এবং অত্রি-অনসূয়ার সামনে দাঁড়ানো শিশুবৎ অগস্ত্য আলাদা।
দেখুন! এখানে ঘটে যাওয়া সমস্ত কাজের দিকে ভালোভাবে তাকান! আপনাদের প্রথম ভুলটি হল - আপনারা অত্রি ঋষির আদেশ পালন করে পত্তল (পাতার তৈরি থালার মতো পাত্র যা থালার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়) ও দ্রোণ তো বানিয়েছেন, কিন্তু স্বয়ং ভগবান অত্রি যখন দ্রোণ বানাচ্ছিলেন, তখন আপনারা তাঁর কৃতিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি এবং সেই কারণে অত্রি ঋষি নিজে তৈরি করা জিনিসগুলির শ্রেণীবিভাগ কীভাবে করেছেন, তা আপনাদের মনে থাকেনি।
ঠিক এই ভুলটি এই কল্পের সত্যযুগের মানুষেরও হচ্ছে। সে জ্ঞান অর্জন করছে, কাজও করছে, কিন্তু এই কল্পের এই মানুষ পর্যবেক্ষণ শক্তি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছে
এবং ঠিক এদিকেই ভগবান অত্রি আপনাদের দিক্দর্শণ করিয়েছেন।
আপনাদের প্রশ্নের অর্ধেক উত্তর পেয়েছেন তো?”
আনন্দিত হয়ে সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা তৎক্ষণাৎ ‘সাধু সাধু’ বলে ভগবান ত্রিবিক্রমের কথায় সমর্থন জানালেন।
এবার ভগবান ত্রিবিক্রম আবার বলতে শুরু করলেন, “প্রিয় ব্রহ্মর্ষিগণ! এবার প্রশ্নের উত্তরের উত্তরার্ধ সম্পর্কে।
আপনারা যে ভুলটি করেছেন, তা এই সমস্ত মহর্ষিরাও করেছেন।
কারণ আপনারা সমস্ত মহর্ষি এবং ঋষিদের শিক্ষকগুরু এবং আপনাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আপনারা আপনাদের শিষ্যদের আদেশ দেওয়ার সময় তাঁদের সামনে সহজভাবে তুলে ধরেননি।
শিক্ষক নিজে ছাত্রদশায় (ছাত্রাবস্থায়) করা ভুলের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠেন এবং তাঁর উচিত সেই অভিজ্ঞতাগুলি তাঁর ছাত্রদের বলে দেওয়া, যাতে তাঁরাও সহজে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে।
সেটিও এখানে ঘটেনি এবং সেই কারণে আপনাদের এই ভালো ছাত্ররাও খুব কম গুণ পেয়েছে।
এই বসুন্ধরার এই কল্পে বর্তমানে ঠিক এটাই হচ্ছে। আপনারা আপনাদের শিষ্যদের তৈরি করতে অর্থাৎ মহর্ষি ও ঋষিদের তৈরি করতে কোথাও ভুল করেননি এবং তাঁরাও বিভিন্ন শিক্ষকদের ভালোভাবে তৈরি করছেন।
কিন্তু এই ঋষি না হওয়া শিক্ষকরা তাঁদের নিজেদের ভুল থেকে যা শিখেছেন, তা তাঁরা তাঁদের ছাত্রদের সামনে তুলে ধরছেন না এবং প্রধানত পর্যবেক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণের পর কাজ এই ক্রমটি ছাত্ররা পাচ্ছে না এবং সেই কারণেই এই কল্পে মানুষের কার্যক্ষমতা খুব দ্রুত কমতে শুরু করেছে।”
অভিভূত হয়ে সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা প্রথমে অত্রি-অনসূয়ার চরণ ধরলেন এবং তারপর ত্রিবিক্রমকেও অভিবাদন জানালেন।
কিন্তু ব্রহ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য কিছু মনে করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। তা বুঝতে পেরে ত্রিবিক্রম তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “হে ব্রহ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য! আপনি তো শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আপনি কেন এমন চিন্তায় পড়ে গেছেন? আপনার মনে কি কোনো প্রশ্ন আছে? আপনি আমাকে যেকোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন।”
ব্রহ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, “হে ত্রিবিক্রম! কিন্তু আমাদের প্রশ্নের একটি ব্যতিক্রম ছিল এবং আছে। ব্রহ্মর্ষি ধৌম্যের আশ্রমে সব কিছু ভালোভাবে চলছে এবং তার কারণও বোঝা যাচ্ছে না। সেখানে সকলে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে অত্যন্ত সুন্দর কাজ করে থাকেন। এর কারণ কী?”
ধৌম্য ঋষিও যাজ্ঞবল্ক্যকে সমর্থন জানালেন, “হ্যাঁ! কিন্তু আমি নিজেও তার কারণ বুঝতে পারিনি।”
ভগবান ত্রিবিক্রম মৃদু হেসে বললেন, “আদিমাতা কোনো প্রশ্ন তৈরি হওয়ার আগেই, তার উত্তর তৈরি করে রাখেন। ব্রহ্মর্ষি ধৌম্য ১০০ বছর দেশভ্রমণে গিয়েছিলেন তখন তাঁর আশ্রমের দায়িত্ব তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহর্ষি মন্দার এবং তাঁর স্ত্রী রাজযোগিনী শমী সামলাচ্ছিলেন।
আপনাদের মনে যে প্রশ্নটি উঠেছে সেটি তাঁদের মনে ৯৯ বছর পূর্বে উপস্থিত হয়েছিল এবং তার জন্য তাঁরা অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই তারা উত্তর পাচ্ছিলেন না এবং সেই সময় অসুরদের গুরুকুলে অবশ্য তাঁদের আসুরি কাজ শৃঙ্খলার সাথে ঠিকভাবে চলছে তা এই দু'জন জানতে পারলেন
এবং এই দু'জন আদিমাতার চরণে তাঁদের তপস্যা ও পবিত্রতা সুরক্ষিত রেখে, দেবর্ষি নারদের সঙ্গে তাম্রতামস অরণ্যে গেলেন এবং তাঁরা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই জ্ঞানার্জন ও কাজের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ শক্তির এবং শিক্ষকদের নিজেদের অতীত জীবনের ভুলগুলি ছাত্রদের সামনে গল্পের আকারে তুলে ধরার মাহাত্ম্য বুঝতে পারলেন এবং তাঁরা তৎক্ষণাৎ তাঁদের আশ্রমে ফিরে এলেন।
আদিমাতার কাছ থেকে তাঁদের পবিত্রতা ও তপস্যা ফেরত পাওয়ার পর তাঁরা পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং ভুলগুলি গল্পের আকারে ছাত্রদের সামনে তুলে ধরার অনুশীলন করা শুরু করলেন। একদিন এইভাবে চিন্তা করতে করতে তাঁরা ধ্যানে মগ্ন হলেন এবং সেই ধ্যানে তাঁরা তাম্রতামসের বিদ্যালয়গুলি দেখতে পেলেন এবং তাঁরা বুঝতে পারলেন যে তাঁরা অজান্তেই অসুরদের অনুকরণ করেছেন - ভালোর জন্য হলেও, অসুরদের অনুকরণ খারাপই;
এবং সেই কারণে তাঁরা দু'জন প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাঁদের সমস্ত সাধনা, উপাসনা, তপস্যা ও পবিত্রতা দেবর্ষি নারদকে দান হিসেবে দিয়ে দিলেন।
তাঁদের এই সাত্ত্বিক আচরণে আদিমাতা অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং তিনি তাঁদের বর চাইতে বললেন। তাঁরা দু'জনেই আমাকেই আরাধ্য দেবতা মানতেন, তাই তাঁরা দু'জনেই আমার কাছেই সঠিক পথ জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কাছেই তাঁরা তাঁদের জন্য আদিমাতার কাছ থেকে বর চাইতে বললেন
এবং এমন করে আমাকে মুশকিলে ফেললেন। আমি তাঁদের সঠিক বর চাওয়ার বুদ্ধি দিতেই তাঁরা দু'জন আদিমাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে আদিমাতা! অসুরদের অনুকরণ ছাড়া উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং উপযুক্ত শিক্ষাদানের মূল উৎস কোথা থেকে আসে এবং তা কীভাবে পাওয়া যায়, তা কি আপনি আমাদের বলবেন? আমরা এই বরই চাই।
![]() |
মূলাধার চক্রের অধিষ্ঠাতা শ্রীমূলার্কগণেশ |
শুধু তাই নয়, অসুরদের ভূমিতেও পবিত্র শ্রদ্ধাবানরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণমূলক কাজ করতে পারে, সেই উৎসও আমাদের জানান।”
তার সাথে সাথে আদিমাতা তাঁদের দু'জনকে ‘তথাস্তু’ বলে বর দিলেন এবং আমাকে তাঁদের দু'জনকে পথ দেখানোর জন্য বললেন।
আমি তাঁদের দু'জনকে নিয়ে এই নৈমিষারণ্যেই এলাম এবং তাঁদের সর্বোচ্চ ধ্যান শেখালাম এবং সেই ধ্যানের মাধ্যমে আমি তাঁদের বুদ্ধির বাইরের জ্ঞানের, আসুরি শক্তির বাইরের সত্ত্বের উৎস দেখালাম।
সেই উৎস অর্থাৎ প্রত্যেকের মূলাধার চক্রের স্বামী ভগবান শ্রীমূলার্ক গণপতি।
নিজেরই মূলাধার চক্রে এবং তার সাথে বসুন্ধরার মূলাধার চক্রে শ্রীমূলার্ক গণপতিকে দেখতে দেখতে, তাঁদের দু'জনেরও সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত হওয়ার ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল হতে লাগল এবং চরম সীমায় পৌঁছে গেল
এবং তাঁদের এই সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ ইচ্ছা আদিমাতার অত্যধিক পছন্দ হল এবং শ্রীগণপতির অত্যন্ত প্রিয় হল।
তারপর মহর্ষি মন্দার থেকে একটি বৃক্ষ সৃষ্টি হল এবং রাজযোগিনী শমী থেকে একটি নমনীয় চারা সৃষ্টি হল।
অর্থাৎ মন্দার বৃক্ষ এবং শমী উদ্ভিদ প্রথমবারের জন্য তৈরি হল
এবং তার সাথে আদিমাতা বর দিলেন যে যে কেউ শ্রীগণপতির যেকোনো প্রতিমার পূজা, বিশেষ করে মূলার্ক গণপতির পূজা মন্দার বৃক্ষের নিচে এবং শমী পাতা দিয়ে করবে, সে এই বুদ্ধির বাইরের পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং আ
সুরি পরিস্থিতিতেও সংকটমুক্ত থাকার শক্তি অর্থাৎ দৈবী প্রজ্ঞা (দৈবী প্রতিভা) লাভ করবে।
এইভাবে এই নৈমিষারণ্যে বিশ্বের প্রথম মন্দার বৃক্ষ এবং প্রথম শমী বনস্পতির সৃষ্টি হল।
এক নিমিষে (চোখের পলক পড়ার সময়) মন্দার বৃক্ষ প্রস্ফুটিত হওয়ায় আমিই তাকে ‘নিমিষবৃক্ষ’ এই নাম দিয়েছি এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ত্রিপুরাসুর যুদ্ধের সময় শিবপুত্রদের তীর আমি নিজেই, শমীর রসে ডুবানো মন্দার বৃক্ষের সমিধা থেকে তৈরি করেছিলাম
এবং সেই কারণে শিবপুত্রদের বর্শা এবং তীর তাম্রতামস অরণ্যের ভূমিতে রোপণ হওয়ার সাথে সাথে, সেখানে জায়গায় জায়গায় মন্দার বৃক্ষ এবং শমীর সৃষ্টি হয়েছে - শ্রদ্ধাবানদের রক্ষা করার জন্য।
এই গল্পটি শুনে সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা অত্যন্ত আনন্দে ধৌম্য ঋষিকে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন
এবং তখনই তাঁদের সকলের মনে হল যে তাঁদের সামনেই মন্দার এবং শমী আছে। সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা অত্যন্ত ভালোবাসা, স্নেহ ও শ্রদ্ধার সাথে মন্দার বৃক্ষকে আলিঙ্গন করলেন
এবং তার সাথে ত্রিবিক্রম সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিদের, সাধারণ শ্রদ্ধাবানদের প্রতি থাকা করুণাকে জল রূপে সেই মন্দার বৃক্ষের মূলে অর্পণ করলেন এবং সেই মন্দার বৃক্ষের মূল থেকে ভগবান ত্রিবিক্রমের হাতে এই বিশ্বের মূলার্ক গণেশের আদ্য স্বয়ম্ভূ মূর্তিটি এল।
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা কৈলাসে স্থিত সকলকে বলতে লাগলেন, “সেইটাই ছিল সেই মুহূর্ত, যখন স্বয়ম্ভূ মূলার্ক গণেশের মূর্তি ত্রিবিক্রম নৈমিষারণ্যে অত্রি ঋষির আশ্রমের সামনে স্থাপন করলেন।
কেন?
মূলার্ক গণেশের মন্ত্র পাঠের কারণে মানুষের প্রজ্ঞা অর্থাৎ ভগবান কর্তৃক তাকে দেওয়া বুদ্ধি, মানুষের মানবিক বুদ্ধি এবং মানবিক মনের উপর অধিকার স্থাপন করে এবং শ্রদ্ধাবানকে সমস্ত সংকট ও ভুল থেকে মুক্ত করে।”
Comments
Post a Comment