রামরক্ষা এই স্তোত্রমন্ত্রের উপর প্রবচন সিরিজের চতুর্থ অংশে সদগুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু ‘সীতাশক্তিঃ’ এই শ্লোক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন যে, রামরক্ষা স্তোত্রের সীতা হল শক্তি। শক্তি মানে শুধু শারীরিক বল, পরমাণু শক্তি বা ধনশক্তি-এর মতো বাহ্যিক বা দৃশ্যমান বিষয় নয়, বরং শক্তি মানে প্রাণশক্তি, যা সমস্ত শক্তির মূল।
বাপু বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন যে, প্রাণ এমন একটি শক্তি যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর উপস্থিতি (Presence) বা অনুপস্থিতি (Absence) থেকে এর অস্তিত্ব বোঝা যায়। শরীরে প্রাণ থাকা অবস্থায় শরীর সক্রিয় থাকে, এবং তা চলে গেলে শরীর নিশ্চল হয়ে যায়, এই থেকেই প্রাণশক্তির অস্তিত্ব বোঝা যায়।
২. প্রাণশক্তি এবং তার কার্য
শরীরে ঘটে যাওয়া ক্রিয়া যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, মস্তিষ্কের কাজ এগুলো নিজে প্রাণ নয়, বরং এই সমস্ত ক্রিয়াগুলোকে প্রাণশক্তি চালিত করে।
এরপর বাপু পরমাণুর উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করে বলেন যে, পরমাণুর মধ্যে প্রোটন এবং ইলেকট্রনের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা যে শক্তি, তাকেই আমরা পরমাণু শক্তি বলি। যখন এই ইলেকট্রনের গঠনে পরিবর্তন হয়, তখনই পরমাণুর মধ্যেকার এই শক্তি বাইরে আসে।
তেমনি, প্রাণশক্তিও সমস্ত বিশ্বের শক্তির মূল রূপ, কিন্তু এটি পরমেশ্বরের নিয়ম অনুসারে কাজ করে। এই কারণেই এটি বিশৃঙ্খল হয় না, এটি একটি নির্দিষ্ট পথে চলে।
প্রাণশক্তি জীবনের পিছনের মৌলিক শক্তি এবং এটি তিনটি রূপে কাজ করে:
(১) তৃষা (ক্ষুধা/প্রয়োজন)
(২) ক্রিয়া (কাজ),
(৩) তৃপ্তি (সন্তুষ্টি).
পৃথিবীর প্রতিটি কাজ এই তিনটি ধাপের মধ্যে দিয়ে যায়; প্রয়োজন তৈরি হয় → কাজ হয় → সন্তুষ্টি পাওয়া যায়।
৩. তৃপ্তির অভাব এবং তার ফলাফল
অনেক সময় চেষ্টা করা হয়, কাজও হয়, কিন্তু তৃপ্তি মেলে না। এই অতৃপ্তিই দুঃখের মূল কারণ। বাপু বলেন যে, শ্রীরাম মানে পুরুষার্থ। সুন্দরভাবে পরিশ্রম করার শক্তিই হল পুরুষার্থ। তৃপ্তি পাওয়ার শক্তিই হল পুরুষার্থ, এবং সীতা মানে তৃপ্তি। কিন্তু আমাদের জীবনে সীতা (তৃপ্তি) রাবণের (দুষ্ট ধারণার) বন্দিদশায় থাকে। তাই পুরুষার্থ থাকা সত্ত্বেও তৃপ্তি মেলে না।
তৃপ্তিই আসল শক্তি। তৃপ্তি থেকেই নতুন সামর্থ্য তৈরি হয়; অতৃপ্তি মানুষের সব শক্তিই নষ্ট করে দেয়। অন্যদের সাথে তুলনা করলেও অতৃপ্তি তৈরি হয়।
বাপু বলেন যে সদগুরুতত্ত্বের কাছে প্রত্যেকের যোগসূত্র আলাদা হয়। তাই তুলনা করে নিজের সুখ-দুঃখ বা লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন না। নিজের শক্তিকে চিনুন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করুন।
৪. তুলনা মানে ভয় তৈরি করা 'কৈকসী' এবং ভয় মানে রাবণ
তৃপ্তিই এই প্রাণশক্তির চূড়ান্ত কাজ। মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, যদি সে অন্যদের সাথে তুলনা করতে থাকে, তবে তার তৃপ্তি মেলে না।
বাপু বলেন, তুলনাই হল ‘কৈকসী’ যে রাবণের মা এবং তার গর্ভেই রাবণ অর্থাৎ ভয় জন্ম নেয়। এই তুলনা এবং ভয় আমাদের পুরুষার্থ (পরিশ্রম) এবং তৃপ্তি (সন্তুষ্টি) থেকে দূরে রাখে।
ভয় তুলনার মাধ্যমেই তৈরি হয়, যা আমাদের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের হীনম্মন্যতায় ফেলে দেয়। তাই মানুষ তার কর্তব্যও সঠিকভাবে করতে পারে না। যেমন কারো গান আসে, কিন্তু মঞ্চে ভয়ে গান গাইতে পারে না, তেমনই আমাদের জীবনেও ভয়ের কারণে আমাদের শক্তি কমে যায়।
৫. আসল মোক্ষ মানে তৃপ্তি
মোক্ষ মানে জগত থেকে দূরে যাওয়া নয়, বরং শরীর, মন, প্রাণ এই সকল স্তরের সম্পূর্ণ তৃপ্তি মানেই আসল মোক্ষ। তুলনা না করে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে থাকা, মনঃশান্তি এবং তৃপ্তি পাওয়া এটাই আসল শক্তি, এবং এটিই শ্রীরামরক্ষার প্রেরণাও বটে।
বাপু বলেন, আমরা কেন দুঃখী হই? কারণ আমরা প্রতিনিয়ত অন্যদের সাথে তুলনা করি। "তার আয় বেশি", "সে আমার মতো মোটা নয়", "সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল", এমন তুলনা করে আমরা আমাদের সন্তুষ্টি হারিয়ে ফেলি। তাই অন্যদের সাথে তুলনা করবেন না।
আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনার শক্তি অনুযায়ী ধাপে ধাপে চলুন। প্রয়োজন হলে মাঝখানে বিশ্রাম নিন। বড় লক্ষ্য অর্জনের আগে পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে খুশি থাকুন। কারণ তৃপ্তি থাকলে তবেই এগিয়ে যাওয়ার শক্তি মেলে। সীতা হল তৃপ্তি এবং তৃপ্তির কোনো তুলনা নেই। সে ‘অতুলা’।
৬. তৃপ্তি ছাড়া কাজ সুসংগত হয় না
তৃপ্তিই হল পুরুষার্থের আসল প্রেরণা এবং তা ছাড়া কোনো কাজ সুসংগত হয় না।
বাপু একটি সহজ উদাহরণ দেন, ধরুন, কোনো জায়গায় আপনি কাজ করছেন এবং মাসের বেতনই পেলেন না, তাহলে পরের মাসে কাজ করার উৎসাহ থাকবে কি?
তেমনই জীবনেও – কাজ (পুরুষার্থ) করলে তা থেকে তৃপ্তি পাওয়া উচিত। পুরুষার্থের প্রতিটি ধাপে তৃপ্তি পাওয়া উচিত। নয়তো আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, হতাশ হয়ে যাই।
'সীতা' তৃপ্তির প্রতীক। তার সম্পর্ক সেরিব্রাল কর্টেক্স (মস্তিষ্কের উচ্চতম অংশ) এবং তার পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট শর্করার (গ্লুকোজ) সাথে আছে। এই শর্করা যদি না মেলে, তবে মানুষের পুরুষার্থই শেষ হয়ে যায়। আমাদের মস্তিষ্ক, আমাদের মন, সন্তুষ্টির (তৃপ্তির) শক্তির উপরই চলে।
তৃপ্তি না পেলে মানুষ মিথ্যা প্রত্যাশা, তুলনার জালে জড়িয়ে পড়ে, এবং এমন সময় মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তৃপ্তি তৈরি হয় – যা বিকৃতি এবং দুর্বলতার দিকে নিয়ে যায়।
৭. রামরক্ষা স্তোত্রমন্ত্র – তৃপ্তি এবং পুরুষার্থকে জাগিয়ে তোলে
রামরক্ষা স্তোত্রমন্ত্রটি "মন্ত্র" এই শব্দের অর্থের সাথে জড়িত। যার মনন করলে রক্ষা পাওয়া যায় সেই হল মন্ত্র। মন্ত্র মানে যা মনোময়ও এবং প্রাণময়ও, সেটাই মন্ত্র।
যেখানে মন এবং প্রাণ একসাথে আসে, সেখানেই পুরুষার্থ অর্থাৎ চেষ্টা ও সাফল্য সম্ভব হয়। রামরক্ষা এই স্তোত্রমন্ত্র – যা পুরুষার্থ ঘটায় এবং তৃপ্তি দেয়।
বাপু তৃপ্তি থেকে পুরুষার্থ, পুরুষার্থ থেকে তৃপ্তির সুন্দর উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, বৃষ্টি হলে জমিতে তৃপ্তি তৈরি হয়, তখন তা বীজগুলিকে অঙ্কুরিত করে, গাছ তৈরি করে। সেই গাছ তাকে ছায়া দেয়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং অন্যদেরও কাজে আসে। শুধুমাত্র নিজের জন্য তৃপ্তি মানে অসম্পূর্ণতা; আসল তৃপ্তি হল অন্যদের কল্যাণের জন্য কাজ করা।
সীতা হল তৃপ্তির শক্তি, আর রাম মানে পুরুষার্থ। তৃপ্তি থেকেই পুরুষার্থ সম্ভব হয় এবং পুরুষার্থ থেকেই আসল তৃপ্তি পাওয়া যায়।
৮. রামরক্ষা – আলস্য নষ্ট করে এবং প্রেরণা দেয়
বাপু বলেন যে রামরক্ষা স্তোত্র পাঠ করলে আমাদের তৃপ্তি বাড়তে শুরু করে এবং এই তৃপ্তি পুরুষার্থ বাড়ায়। এই তৃপ্তি আলস্য দূর করে, প্রেরণা দেয় এবং মনোবল বাড়ায়।
এই স্তোত্রের প্রভাবে আমাদের কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং রাম অর্থাৎ সব ধরনের পুরুষার্থের মূল উৎস পাওয়া যায়।
যদি একজন সাধারণ মানুষ যে আধ্যাত্মিকতাও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না সেও যদি মন থেকে রামরক্ষা বলতে শুরু করে, তাহলে তার মনের আলস্য আপনাআপনি চলে যায়। তার কাজ করার প্রেরণা মেলে। শুধু রামরক্ষা বলার সময়, ভক্তি করার সময় তুলনা করা উচিত নয়। কারণ তুলনা হলে তৃপ্তি চলে গেল। তৃপ্তি এবং পুরুষার্থ এই দুজনের সম্পর্ক সবসময় একে অপরের পরিপূরক, সীতা ছাড়া রাম এবং রাম ছাড়া সীতা থাকা সম্ভব নয়। রামরক্ষা স্তোত্রমন্ত্রে এই 'সীতা' অর্থাৎ তৃপ্তি কাজ করে, আর 'রাম' মানে পুরুষার্থ – শক্তি, ওজঃ।
সদগুরু অনিরুদ্ধ বলেন যে আয়ুর্বেদ অনুযায়ী সীতা শান্ত-স্নিগ্ধতা অর্থাৎ তৃপ্তি, আর রাম মানে উষ্ণ-স্নিগ্ধতা অর্থাৎ পুরুষার্থ (অর্থাৎ শক্তি) এর প্রতীক।
রাম নাম অর্থ ওজঃ তৈরি করার শক্তি, ওজঃ দেওয়ার শক্তি। ওজঃ এর মূল উৎস রাম। ওজঃ ছাড়া তৃপ্তি নেই এবং তৃপ্তি ছাড়া ওজঃ নেই। রামরক্ষা স্তোত্রমন্ত্রের পাঠেই এই দুটি জিনিস আমি পেতে পারি।
৯. রামরক্ষা স্তোত্রের সৃষ্টি - বুধকৌশিক ঋষি
রামকে পেতে হলে প্রথমে তৃপ্তি অর্থাৎ সীতা আবশ্যক বলে বাপু স্পষ্ট করে বলেন। রামরক্ষা স্তোত্র তৃপ্তি এবং পুরুষার্থ, দুটিকেই জাগিয়ে তোলে। এবং এই স্তোত্র বুধকৌশিক ঋষি অত্যন্ত তৃপ্ত অবস্থায়, সমস্ত জীবের কল্যাণের জন্য লিখেছিলেন। বুধকৌশিক ঋষি সম্পূর্ণ তৃপ্ত ছিলেন এবং এই তৃপ্তি থেকেই তার মনে সমগ্র বিশ্বের কল্যাণে পুরুষার্থ করার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল এবং রামরক্ষা এই স্তোত্রমন্ত্রটি জন্ম নিয়েছিল। তাই এর থেকে পাওয়া তৃপ্তি এবং পুরুষার্থ অতুলনীয়।
Comments
Post a Comment