রামরক্ষা প্রবচন ৫ - জীবনের গুরুকিল্লি

রামরক্ষা প্রবচন ৫ - জীবনের গুরুকিল্লি

রামরক্ষা স্তোত্রমন্ত্র সিরিজের পঞ্চম প্রবচনে, সদ্গুরু অনিরুদ্ধ বাপু 'শ্রীমদ্ হনুমান কিলকম' শ্লোক সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি বোঝান যে, আমরা যেমন একটি লকার বা ক্যাবিনেটের জন্য তালা এবং তার চাবি (কিলক) ব্যবহার করি, তেমনি আমাদের জীবনের গুরুকিল্লি (মাস্টার কী) আমাদের সদ্গুরু ছাড়া আর কারো কাছে থাকে না এবং এটি আমাদের জানা নেই। আমাদের সঠিক 'কিলক', অর্থাৎ সঠিক গুরুকিল্লি প্রয়োজন।

বাপুজি পরিষ্কার করে বোঝান যে, আমরা প্রতিটি মুহূর্তে যা করি, প্রতিটি কর্মই এক একটি "চাবি"। সেই চাবিই আমাদেরকে আমাদের পূর্বকর্মজনিত ভোগের দিকে নিয়ে যায়। ভুল কর্মের ফলে ভুল তালা খুলে যায়, আর দুর্ভাগ্যবশত যদি কোনো ভুল তালা খুলে যায়, তবুও আমার কাছে থাকা সৎ কর্মের চাবি দিয়ে আমি শুভ তালাগুলিও খুলতে পারি। অর্থাৎ, আমার যে কর্মস্বাধীনতা রয়েছে, সেই স্বাধীনতাই হলো সেই চাবিগুলো, যার সাহায্যে আমি আমার পূর্বকর্মের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারি। তবে কর্ম করতে গিয়ে আমাকে অবশ্যই "'ফলের ইচ্ছার উপর পূর্ণ বিরাম' (ফলাশেচা পূর্ণ বিরাম) রাখতে হবে। এর মানে কাঙ্ক্ষিত ফলের প্রত্যাশা না করে, ঈশ্বর যা দেবেন তাই বিনম্রচিত্তে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিয়েই কাজ করতে হবে।

'আনন্দ পাওয়া' এটাই মানুষের স্বধর্ম। কিন্তু আনন্দের একটি নির্দিষ্ট রূপের প্রত্যাশা করা হলো 'ফলাশা', যা আমাদের দুঃখ দিতে পারে। তাই, আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, কিন্তু ফল কতটা, কীভাবে এবং কখন পাওয়া যাবে, এই সমস্ত পরিকল্পনা ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিতে হবে।


প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিসাদের মধ্যে পার্থক্য

সদ্গুরু অনিরুদ্ধ বলেন যে, জীবনের ঘটনাগুলিতে আমাদের 'রিয়্যাক্ট' না করে অর্থাৎ প্রতিক্রিয়া না দিয়ে 'রেসপন্স' অর্থাৎ প্রতিসাদ দেওয়া উচিত। প্রতিক্রিয়া দায়িত্বহীন হয়, যখন প্রতিসাদ দায়িত্ব নিয়ে করা একটি কাজ। জীবনে আমরা কীভাবে আচরণ করব, এটি আমাদের হাতে আছে, এবং আমরা কোনো পরিস্থিতিতে প্রতিসাদ দেই নাকি প্রতিক্রিয়া, তার উপরই আমাদের জীবনের সঠিক-ভুল দিক নির্ধারিত হয়।

বাপু একটি উদাহরণ দেন: বাবা-মা তাদের সন্তানের পরীক্ষার ব্যর্থতা দেখে সঙ্গে সঙ্গে রেগে যান (Reaction), কিন্তু দায়িত্বশীল (Responsible) বাবা-মা ভালোবাসা এবং ইতিবাচকতার সাথে প্রতিসাদ দেন। আমাদের দায়িত্ব কীভাবে পালন করতে হবে তা আমরা হনুমানের জীবন থেকে শেখা উচিত, কারণ হনুমানের কাহিনী আমাদের শেখায় যে আমাদের আচার, ভক্তি এবং দাসত্ব কেমন হওয়া উচিত।


মহাভারতে হনুমান এবং তার নামভক্তি

যেখানে রাম নাম নেওয়া হয়, সেখানে তিনি থাকেনই। তিনি যুগ যুগ ধরে রাম নাম নিচ্ছেনই। হনুমান আদর্শ ভক্ত এবং দাসোত্তম। আমাদের সকলের জন্য তার শ্রবণভক্তি, নামসংকীর্তন এবং সেবা মনোভাব একটি আদর্শ। এই হনুমান যেকোনো মন্দিরে আনন্দে থাকেন, গ্রামের প্রবেশপথে বা গাছের নিচেও তার মন্দির থাকে।

মহাভারতের যুদ্ধে, কৃষ্ণের নির্দেশে হনুমান অর্জুনের রথের পতাকায় বিরাজিত হয়েছিলেন। তখন হনুমান কেবল তার রামকে আবার যুদ্ধ করতে দেখতে এবং তার কণ্ঠস্বর শুনতে চান। হনুমান কৃষ্ণের মধ্যেই রামের রূপ দেখতে পান। কৃষ্ণও হনুমানকে তার দর্শন সর্বদা যেন পাওয়া যায়, তাই রথের উপর থেকে নিজের ছাতাটিও সরিয়ে দেন। হনুমান সেই সময় 'কৃষ্ণনাম' জপ করছিলেন, কিন্তু অর্জুন 'রাম নাম' শুনছিলেন, এবং যখন হনুমান রাম নাম জপ করছিলেন, তখন অর্জুন 'কৃষ্ণ নাম' শুনছিলেন। সদ্গুরু অনিরুদ্ধ এই গল্পের মাধ্যমে বলেন যে, আমাদের এই নামের বিভ্রান্তিতে আটকে পড়া উচিত নয়, কারণ আসল নাম নেওয়ার দায়িত্ব (Responsibility) এই হনুমানের এবং তিনি তা করছেন। তাই, আমাদের কেবল সেই নামই জপতে হবে যা হনুমান উচ্চারণ করেন। তিনি যুগ যুগ ধরে যে নাম জপ করছেন, তাতে আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্র অবদান রাখতে হবে। কারণ নামসংকীর্তনের ভক্তি তার মতো আর কারোর নেই।


দাসোত্তম হনুমানের নববিধা ভক্তির আদর্শ

সদ্গুরু অনিরুদ্ধ বলেন যে, নববিধা ভক্তির প্রতিটি প্রকারেই হনুমান শ্রেষ্ঠ। রামের সামনে সবসময় তার হাত জোড় করা থাকে (বন্দন ভক্তি), হনুমান সর্বদা রাম নাম জপ করতে থাকেন (নামস্মরণ), হনুমান রামের চরণের কাছে বসে থাকেন (অর্চন ভক্তি), রামের জন্য সবকিছু উৎসর্গকারী সেই সেবক তিনি (দাস্য ভক্তি)। রাম, লক্ষ্মণ নাগপাশে আবদ্ধ হলে বা লক্ষ্মণ মূর্ছিত হলে, দৌড়ে সঞ্জীবনী আনতে যান হনুমান। আমরা শ্রী হনুমান চালিসাতেও শুনি যে রাম হনুমানকে বলেন - 'তুম মম প্রিয় ভরতহি সম ভাই।' এই সখ্যও (সখ্য ভক্তি) হনুমানের কাছে আছে। রামের কথা এবং রামের কাজই হনুমানের জীবন (আত্মসমর্পণ)। হনুমানের প্রেম, উৎসর্গ সর্বোচ্চ, তাই নববিধা ভক্তির প্রতিটি প্রকারেই তিনি শ্রেষ্ঠ।

হনুমান আমাদের 'প্রতিসাদ অর্থাৎ রেসপন্স দেওয়ার শিল্প' এবং 'নববিধা ভক্তির নয়টি ধাপ' শেখান। যেকোনো কিছুতে (যেমন, গান, শিক্ষা, সাধনা) সফল হওয়ার জন্য নববিধা ভক্তির নয়টি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ এবং সেগুলি হলো: শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, বন্দন, অর্চন, পাদসংবাহন, দাস্য, সখ্য, আত্মসমর্পণ।


হনুমান - রামরক্ষার 'কিলক'

বাপু আরও বলেন যে, হনুমানই রামরক্ষার 'কিলক'। সুতরাং, হনুমানের দ্বারা করা পাদসংবাহন, হনুমান আমাদের যে পাদসংবাহন শিখিয়েছেন, সেটাই জীবনের 'গুরুকিল্লি'।

রাম মানে পুরুষার্থ এবং সীতা মানে এই পুরুষার্থ থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তি। পুরুষার্থ দ্বারা তৃপ্তি কীভাবে বৃদ্ধি করতে হয় এবং তৃপ্তি দ্বারা পুরুষার্থ কীভাবে বৃদ্ধি করতে হয় তার রহস্যই হলো রামরক্ষা। এই হনুমান এই রামরক্ষার কিলক কেন, তাকে এই রামরক্ষার চাবি কেন বলা হয়, তা সদ্গুরু বাপু তখন হনুমানের গল্প থেকে স্পষ্ট করেন।

হনুমান, তার জীবনের প্রতিটি গল্পের মাধ্যমে, জন্ম থেকেই আমাদের চাবি দিতে থাকেন যে পুরুষার্থ এবং তৃপ্তি অর্থাৎ রাম এবং সীতার সম্পর্ক আমি আমার জীবনে কীভাবে আনব? 'শ্রীমদ্ হনুমান কিলকম' যখন আমি ভক্তিভরে বলি, তখন হনুমান নিজে কাজে লেগে যান। তিনি আমার মনে এই মনোভাব তৈরি করেন যে রামই সবচেয়ে সুন্দর ফল। এই অনুভূতিগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করার কাজটি এই হনুমান করেন। আমাকে রাম নামের, কৃষ্ণ নামের, গুরু নামের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করার সব প্রস্তুতি এই হনুমান করেন, তাই তাকে 'কিলক' বলা হয়েছে। আমাদের মনে যে অনেক বন্ধ কপাট আছে সেগুলি খোলার জন্য হনুমান নিজেই চাবি নিয়ে বসে থাকেন।

লঙ্কা দহনের গল্প থেকে হনুমান আমাদের শেখান যে 'রিয়্যাক্ট' না করে 'রেসপন্স' কীভাবে দিতে হয়? দায়িত্ব নিয়ে কীভাবে আচরণ করতে হয়? সীতা মা হনুমানকে যে মালা দিয়েছিলেন তার গল্প থেকেও বাপু আমাদের বলেন যে আমাদের কী চাইতে শেখা উচিত।

সদ্গুরু অনিরুদ্ধ বলেন যে, হনুমান এবং শ্রীরামের প্রথম সাক্ষাতের গল্প থেকেও নিজের দায়িত্ব, জবাবদিহিতা, কর্তব্য কীভাবে পালন করতে হয় তা হনুমান আমাদের বারবার শেখাতে থাকেন। এই প্রবচনের শেষে বাপু বলেন যে, 'রামরক্ষা আমাদের পুরুষার্থও দেয় এবং তৃপ্তিও দেয় মানে কী দেয়? আমাদের যে সত্যিকারের দায়িত্ব আছে, তা সম্পূর্ণ করার ক্ষমতা আমরা রামরক্ষা থেকে পাই এবং তার কিলক কে? হনুমান। কারণ তিনিই একমাত্র যিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে জানেন।

Comments