‘ছন্দ’ মানে কী – অনুষ্টুপ ছন্দের স্বরূপ ও উৎপত্তি
রামরক্ষা এই স্তোত্রমন্ত্রের উপর প্রবচনে সদগুরু অনিরুদ্ধ ‘অনুষ্টুপ ছন্দঃ’ এই লাইন থেকে ‘ছন্দ’ মানে কী তা প্রথমে বলেছেন। বাপু বলেন, "ছন্দ" মানে কবিতা বা স্তোত্র তৈরি করার সময় ব্যবহৃত একটি নির্দিষ্ট গঠন পদ্ধতি। রামরক্ষা "অনুষ্টুপ" ছন্দে রচিত। এই ছন্দটি প্রতিটি চরণে ৮টি অক্ষরযুক্ত ৪টি চরণ দিয়ে গঠিত — অর্থাৎ মোট ৩২টি অক্ষরের।
এই ছন্দের উৎপত্তি বাল্মীকি ঋষির সাথে সম্পর্কিত ক্রৌঞ্চ পক্ষী দম্পতির গল্প থেকে। একটি ক্রৌঞ্চ পক্ষী এবং তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ দেখে তার হৃদয় থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে শব্দগুলো বেরিয়ে এসেছিল, সেগুলিই অনুষ্টুপ ছন্দে ছিল এবং পরে তিনি রামায়ণ এই ছন্দেই লিখেছিলেন। তাই এই ছন্দকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়।
এই ছন্দ ‘গায়ত্রীপুত্র’ ও ‘ছন্দযোনি’ নামেও পরিচিত। সদগুরু অনিরুদ্ধ আরও বলেন যে, রামরক্ষার এই ছন্দের রূপ ও রচনাকথা বুঝলে আমরা যে শব্দগুলো বলি তার পেছনের আসল সৌন্দর্য, অর্থ এবং শক্তি আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারি।
উপদেশ বা গ্রন্থ থেকে কোনো নির্দেশনা গ্রহণ করার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে
বাপু আরও বলেন যে কোনো উপদেশ বা গ্রন্থ থেকে কোনো নির্দেশনা গ্রহণ করার সময় আমাদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো দেখতে হয়:
এই উপদেশ দেওয়া ব্যক্তি বা গ্রন্থের উপর আমাদের বিশ্বাস আছে কি?
এই উপদেশ দ্বারা আমাদের জীবনে কী প্রভাব পড়বে।
উপরের বিষয়গুলো একটি মৌলিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং তা হলো সেই ব্যক্তি বা গ্রন্থকারের আমাদের প্রতি থাকা প্রেম।
প্রেমহীন পরামর্শ কার্যকর হয় না। যখন উপদেশ প্রেম হতে আসে, তখন তা হৃদয়ে স্পর্শ করে এবং জীবন পরিবর্তন করে।
অনুষ্টুপ ছন্দ – ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া ছন্দ
রামরক্ষা স্তোত্রের "অনুষ্টুপ ছন্দ" এই ভালোবাসার প্রতীক। বাল্মীকি ঋষির ক্রৌঞ্চ পক্ষীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও, ক্রৌঞ্চ দম্পতির বিচ্ছেদে ব্যথিত হয়ে তিনি যে শব্দে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, তা থেকেই এই ছন্দের জন্ম হয়েছিল। আর এই ছন্দের কারণে সেই মৃত ক্রৌঞ্চটিও আবার জীবন ফিরে পেয়েছিল। তাহলে অনুষ্টুপ ছন্দে রামরক্ষা পাঠ করে আমরা আমাদের দুঃসহ প্রারব্ধময় জীবন পরিবর্তন করতে পারি না কি?
এই অনুষ্টুপ ছন্দ রামরক্ষার প্রতিটি লাইনে আছে; এবং এই কারণেই এই ছন্দ আমাদের মৃত হয়ে যাওয়া অনুভূতি, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাকে আবার সজীব করার শক্তি দেয়। কিন্তু তার জন্য আমাদের মনে রামের প্রতি ভালোবাসা থাকা আবশ্যক।
ভক্ত ও ভগবানের মধ্যেকার দ্বৈততা দূর করা সাধু চোখামেলা ও সাধু বঙ্কা মহারের গল্প
সদ্গুরু অনিরুদ্ধ ওয়ারকরী সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সন্ত চোখামেলা ও সন্ত বাঙ্কা মহার-এর কাহিনি বলেন। সন্ত চোখামেলা ও সন্ত বাঙ্কা মহার – এঁরা একে অপরকেই নিজের গুরু মনে করতেন এবং এই ভালোবাসায়, অহংকারশূন্য অবস্থায় তাঁরা একাত্ম হয়ে যেতেন। মুক্তাবাই তাঁদের বলেন যে – “গুরু হওয়ার চেয়ে শিষ্য হয়ে থাকার মধ্যেই বেশি আনন্দ।” শেষমেষ রুখুমাই হস্তক্ষেপ করেন এবং তাঁদের উভয়কে অদ্বৈতের অবস্থায় নিয়ে যান – দু’জন সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হয়ে যান। এই অদ্বৈত অবস্থা পাণ্ডুরঙ্গের কৃপায় এবং অনুষ্টুপ ছন্দের মাধ্যমে ঘটে। এই কাহিনি থেকে সদ্গুরু অনিরুদ্ধ প্রমাণ করেন যে এই ছন্দ কেবলমাত্র রচনা নয়, বরং ভক্তিকে দৃঢ় করে ভক্ত ও ভগবান-এর মধ্যে যে দ্বৈততা আছে তা দূর করে প্রেমের সেতু গড়ে তোলে।
অনুষ্টুপ ছন্দ এবং ভগবানের দায়িত্ব
অনুষ্টুপ ছন্দের গুরুত্ব বলতে গিয়ে সদগুরু অনিরুদ্ধ স্পষ্ট করে বলেন যে, যখন কোনো ভক্ত এই ছন্দ মন থেকে উচ্চারণ করে, তখন সেই ভগবানের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার দায়িত্ব সেই ভক্তের উপর থাকে না, বরং ভক্তকে নিজের সাথে একাত্ম করে নেওয়ার সেই দায়িত্ব স্বয়ং পরমেশ্বর নেন। তাই অনুষ্টুপ ছন্দে এই রামরক্ষা স্তোত্র অত্যন্ত কার্যকর।
সুন্দরকাণ্ড – ভক্তির শিখরে হনুমানের অবস্থান
রামায়ণের ‘সুন্দরকাণ্ড’ রামায়ণের সবচেয়ে সুন্দর কাণ্ড বলে মনে করা হয়। এই অংশে হনুমানের অসাধারণ ভক্তি এবং সেবার মনোভাবের বর্ণনা আছে। সীতার শোক দূর করার জন্য তিনি “সীতাশোকবিনাশক” হন। সীতার রামের কাছে করা প্রার্থনা অর্থাৎ, "দীনদয়াল বিরুদু সম্ভারি, হরহু নাথ মম সংকটভারী" এটি একটি শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা কারণ এইখানে ভক্তিরূপিণী সীতা রামকে নিজের নাথ রূপে, ঈশ্বর রূপে প্রার্থনা করেছেন এবং সীতার সেই প্রার্থনা রামের কাছে পৌঁছে দেন স্বয়ং রামদূত হনুমান।
হনুমানের ত্যাগ, শুদ্ধ ভক্তি, নম্রতা এবং তার রাম ও সীতার প্রতি থাকা অপরিসীম প্রেমের কারণে তিনি শ্রেষ্ঠ ভক্ত রূপে পরিচিত। তিনি শুধু মুখ দিয়ে রাম নাম নেন না, তার দেহের প্রতিটি কোষ রাম নামে পূর্ণ। তাই তাকে 'সীতাশোকবিনাশক' এবং আদর্শ ভক্ত মনে করা হয়।
যযাতি ও রামের অসাধারণ গল্প
প্রবচনের শেষে বাপু রামভক্ত যযাতির যে গল্পটি বলেন, তাতে তার রামের প্রতি ভক্তির সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। যযাতি নামে একজন রাজা ছিলেন এবং তিনি রামের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও ভক্ত ছিলেন। দুর্বাসা ঋষি রেগে গিয়ে রামের কাছ থেকে যযাতিকে হত্যা করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নেন। সীতা, যযাতির স্ত্রীকে সংবাদ পাঠিয়ে সাবধান করেন, কিন্তু নিজ অবতার ধর্মের সীমা তিনি অতিক্রম করেন না। ঠিক ঐ সময়ে অঞ্জনি মাতা তার পুত্র অর্থাৎ হনুমানের নিকট হতে যযাতিকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি নেন। এর ফলে রাম এবং হনুমানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। রামের নিক্ষেপ করা তীর হনুমানের বক্ষ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে যায় এবং ঠিক সেই মুহূর্তে রামের মৃত্যু হয়। কারণ হনুমানের হৃদয়ে রামই আছেন। শেষ পর্যন্ত সীতার কথায় রাম আবার জীবিত হন। এই গল্প দেখায় যে, যেমন হনুমানের হৃদয়ে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা আছেন, তেমনই সেই রামের হৃদয়েও এই হনুমান আছেন। এটি হনুমানের ভক্তির সৌন্দর্য, তাই এই সুন্দরকাণ্ড এত সুন্দর।
সুন্দরকাণ্ড – স্বয়ম্ভূ অনুষ্টুপ ছন্দ এবং পরাবাণীর ধ্বনি
সুন্দরকাণ্ড স্বয়ম্ভূ অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। সদগুরু অনিরুদ্ধ ‘অনুষ্টুপ’ শব্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বলেছেন যে, অনুষ্টুপ মানে এমন একটি ধ্বনি যা কোনো কিছুর বিস্ফোরণ ঘটায় না, যা কোনো কিছু ভাঙে না বা যা ভেঙে বাইরে আসে না। আওয়াজ তৈরি করতে আমাদের বিস্ফোরণ ঘটাতে হয় অথবা একটি ধাতুর উপর অন্য ধাতু বা ধাতুর উপর কাঠের টুকরো মারতে হয়। অনুষ্টুপ এমন একটি ধ্বনি যা কোনো আঘাত ছাড়া উৎপন্ন হয় অর্থাৎ পরাবাণীর শব্দ। তুলসীদাস সুন্দরকাণ্ড উচ্চারণ করেননি বরং হনুমান তাকে তা সরাসরি ঘটতে দেখিয়েছিলেন এবং তা স্বয়ং হনুমানই লিখেছিলেন। তুলসীদাসের হনুমানের প্রতি প্রেম এবং তার মনের ভাব জেনে হনুমান যে রচনা করেছিলেন সেটিই সুন্দরকাণ্ড, তাই এই সুন্দরকাণ্ডই সম্পূর্ণভাবে অনুষ্টুপ। এই রামরক্ষা অনুষ্টুপ, এই পুরো রামায়ণ অনুষ্টুপ। কারণ রামই অনুষ্টুপ। গায়ত্রীর পুত্রই অনুষ্টুপ এবং তিনিই শ্রীরাম।
Comments
Post a Comment