সন্দর্ভ – সদ্গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক ‘প্রত্যক্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘তুলসীপাতা’ শিরোনামের এই অগ্রলেখমালার অগ্রলেখ নং ১৩৯৮ এবং ১৩৯৯।
সদ্গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু ‘তুলসীপত্র’ – ১৩৯৮ এই অগ্রলেখে লিখেছেন,
শ্রীশাম্ভবীমুদ্রার সমস্ত বর্ণনা এবং তার বিষয়ে সাবধানতা—এই সবকিছু ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার পর সকল শিবগণ, ঋষিকুমার, ঋষি এবং এমনকি মহর্ষিরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে প্রবীণ ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রাকে অনুরোধ করতে লাগলেন, “হে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবাদিনী! আমাদের শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা, অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী এবং তিনি আমাদের যে অষ্টদল শ্বেতপুষ্প দিয়েছেন, সে বিষয়ে আরও কিছু জানার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে। এই ইচ্ছা আমাদের হাতে স্থায়ীভাবে লেগে থাকা এই শ্বেতপুষ্পের সুগন্ধের কারণে আরও বাড়ছে। আমাদের উপর কৃপা করুন।”
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা মহাগৌরী এবং আদিমাতার অনুমতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, “হ্যাঁ! তোমাদের জিজ্ঞাসা সেই শ্বেতপুষ্পের কারণেই বাড়ছে।
শ্রদ্ধাবান এবং সজ্জনদের আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পবিষয়ক, ব্যবসাবিষয়ক, কারিগরিবিষয়ক, দেশরক্ষা-ধর্মরক্ষা বিষয়ক, পারিবারিক—এমন সকল ক্ষেত্রের জিজ্ঞাসা সঠিক পথে এবং সঠিক ক্রমে বাড়ানোর কাজ এই অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী করে থাকেন।
কারণ এই ‘মহাগৌরী’ রূপ থেকেই, তাঁর শরীরের উপর স্বয়ং পরমশিবের দেওয়া সপ্তম গঙ্গার প্রলেপ থেকে গণপতির জন্ম হয়েছে। আর এই গণপতি বিশ্বের ঘনপ্রাণ এবং বুদ্ধি, প্রকাশ ও বিঘ্ন দূরকারী।
তাহলে তাঁর মাতা এই মহাগৌরী তাঁর ভক্তদের অর্থাৎ শ্রদ্ধাবানদেরকে গণপতির কাছ থেকে সকল বর পাওয়ার ব্যবস্থা করবেনই তো! আর এই জন্যই তিনি শ্রদ্ধাবানদের মনে ভালো ও উপকারী জিজ্ঞাসা তৈরি করেন এবং সেগুলো পূর্ণও করেন।
প্রিয় আপ্তজনগণ! এই এক পার্বতীরই অষ্টমীর রূপ মহাগৌরী, এই ভাবে কাজ করেন বলেই নবরাত্রিতে অষ্টমীর তিথির মাহাত্ম্য সব জায়গায় বিখ্যাত।
বেশির ভাগ জায়গায় এবং অঞ্চলে নবরাত্রির অষ্টমীর দিনে হোম, হবন, যজন, যজ্ঞ করা হয়, তা শুধুমাত্র এই কারণে - কারণ পার্বতীর জীবনযাত্রার এই ‘মহাগৌরী’ অবস্থা অর্থাৎ ধাপ বা রূপটি আগের সাতটি রূপের সঙ্গেও একাকার হয়ে আছে এবং পরের নবম রূপের সঙ্গেও একাকার হয়ে আছে।
আর এই কারণে অষ্টমীতে করা হোম ন’জন নবদুর্গার নিকট সমানভাবে পৌঁছায়।
একই ভাবে, এই মহাগৌরীও আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতেই প্রকাশিত হয়েছিলেন।
অষ্টমীর দিনে করা হোম, পূজা, আনন্দোৎসব, ভক্তিনৃত্য (গরবা ইত্যাদি) এবং রাতের জাগরণ, আদিমাতার চরিত্রের পাঠ (মাতৃবাৎসল্যবিন্দানম্), আদিমাতার কাজ এবং গুণের কীর্তন শোনা ও পাঠ করা (মাতৃবাৎসল্য উপনিষদ), এই সবকিছু স্বয়ং আদিমাতা এবং ন’জন নবদুর্গার কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
-এমনকি আশ্বিন শুক্ল অষ্টমী এই দিনটি সকল শ্রদ্ধাবানদের জন্য একটি বড় বর।
- শ্রদ্ধাবানদেরকে এই নবরাত্রির পূজার কারণে এই ন’জন নবদুর্গাই সাহায্যকারী হন। আর এই মহাগৌরী এবং স্কন্দমাতা নিজেদের সন্তানদের সাথে সত্যিকারের শ্রদ্ধাবানের বাড়িতেই নিজেদের আশীর্বাদময় স্পন্দন বছরভর ছড়িয়ে দিতে থাকেন।
আর এই জন্যই শ্রদ্ধাবানের নিজের সাধ্য মতো আশ্বিন নবরাত্রি এবং চৈত্র নবরাত্রি—এই দুটি অত্যন্ত পবিত্র উৎসব নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং আনন্দোৎসব করে পালন করা উচিত।
হে শ্রদ্ধাবানগণ! যে শ্রদ্ধাবান ‘মাতৃবাৎসল্যবিন্দানম্’ এবং ‘মাতৃবাৎসল্য উপনিষদ’ এই গ্রন্থগুলি নিয়মিত শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ করে এবং প্রত্যেক নবরাত্রিতে একটি করে গ্রন্থ পাঠ করে, তাকে এই মহাগৌরী আট বছর পর এই শ্বেতপুষ্প প্রদান করেন।
আর একবার যদি সেই শ্বেতপুষ্প শ্রদ্ধাবানের হাতে লেগে যায়, তবে তা চিরকালের জন্য।
কারণ সেই শ্বেতপুষ্পটি আসলে সেই শ্রদ্ধাবানের লিঙ্গদেহে লেগে যায়।
আর এই কারণে তার কোনো জন্মেই সেই শ্বেতপুষ্প তার থেকে আলাদা হয় না।
এখন প্রশ্ন হলো এই ফুল অষ্টদলের কেন?
উত্তর আদিমাতার ‘শাকম্ভরী শতাক্ষী’ অবতারে দেওয়া আছে - মানুষকে পারিবারিক জীবন যাপন করতে হোক বা আধ্যাত্মিক জীবন বা দুটোই।
![]() |
শ্রীশ্বাসম্ উৎসবে আদিমাতা শতাক্ষীর দর্শন নিচ্ছেন সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু। |
কিন্তু সেই প্রতিটি কাজের জন্য তাকে শারীরিক, প্রাণিক ও মানসিক স্তরে অন্ন, জল ও বায়ু লাগবেই।
আর মানুষের ত্রৈলোক্য দেহের জন্য যে অন্ন, জল, বায়ু প্রয়োজন তা আদিমাতার অষ্টধা প্রকৃতি থেকেই আসে।
আর এই শ্বেত অষ্টদলপুষ্প সেই অষ্টধা প্রকৃতিরই আশীর্বাদ। আর তা-ও শ্বেত অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ এবং পবিত্র।”
(বাপু এরপর ১৩৯৯ সংখ্যক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন,
এইভাবে নবরাত্রির অষ্টমী তিথির মাহাত্ম্য এবং মহাগৌরীর দেওয়া শ্বেত অষ্টদলপুষ্পের বিষয়ে শ্রদ্ধাবানদের বোঝানোর পর ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা সেখানে উপস্থিত সকল ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীদের, আদিমাতার অনুমতি নিয়ে, সেখানে উপস্থিত ভক্তদের ছোট ছোট দলগুলোকে ‘শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা’ বাস্তবে করে দেখাতে অনুরোধ করলেন।
প্রত্যেক ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনী নিজেদের নিজেদের দলকে নিয়ে আলাদা আলাদা জায়গায় গিয়ে বসলেন।
কে কার কাছে যাবে, তা সদগুরু ত্ৰিবিক্রমই বললেন। এবং কোথায় বসতে হবে সেটাও বললেন।
প্রত্যেক শিবগণ ও ঋষিসমূহ, নিজেদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বসতেই আশ্চর্যের মহাসাগরে ডুব দিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলেন।
কারণটাও একই ছিল - প্রত্যেক ব্রহ্মর্ষি বা ব্রহ্মবাদিনীর দলের পাশে একটি করে গঙ্গানদী প্রবাহিত হচ্ছিল।
প্রত্যেক ব্রহ্মর্ষি বা ব্রহ্মবাদিনীর আসনের পিছনে একটি ফুলভরা বেলগাছ ছিল।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রত্যেক দল অন্যান্য দলের দৃশ্যও দেখতে পারছিল।
কত বড় বড় গঙ্গা! কত বড় বড় বেলগাছ! আর কোথায় কোথায় দেখবে?
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রাকে কোনো দল দেওয়া হয়নি। তাঁকে তাঁর পথপ্রদর্শকের কাজটি করতে হয়েছিল।
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা অত্যন্ত বিনম্র ভঙ্গিতে আদিমাতা শ্রীবিদ্যার চরণে গিয়ে দাঁড়ালেন -
“হে সমস্ত শ্রদ্ধাবান আপনজনেরা! এখন আপনারা সবই দেখেছেন এবং তার আশ্চর্যতাও অনুভব করেছেন। তাই এই মুহূর্ত থেকে আপনাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ গোষ্ঠীর সদ্গুরুর দিকেই
মন একাগ্র করে রাখুন।”
তোমাদের গুরুদেব আজ তোমাদেরকে শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা প্রদান করবেন না, বরং কেবল তোমাদের সামনে করে দেখাবেন।”
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রার কথা অনুযায়ী সেখানকার প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি কেবল নিজেদের গুরুদেবের দিকে দেখতে শুরু করলেন।
প্রত্যেক ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনী অর্থাৎ ‘ব্রহ্মগুরু’ এখন পদ্মাসনে স্থির হয়ে বসেছিলেন।
তাঁরা প্রথমে দুই হাত জোড় করে দত্তগুরু ও আদিমাতার প্রার্থনা করলেন এবং তারপর তাঁরা নিজেদের চোখ বন্ধ করে বসে গেলেন।
তাঁদের আর কোনো নড়াচড়া হচ্ছিল না - এমনকি চোখের পাতা বা নাসিকার ছিদ্রেরও নয়;
আর এই কারণে চোখের পাতার আড়ালে কী চলছে, তা সামনে বসা কেউ দেখতে পারছিল না।
কিন্তু কৈলাসে আর তাও আদিমাতা ও ত্রিবিক্রমের উপস্থিতিতে এমনটা কীভাবে ঘটতে পারে?
না! এখানে এমন অবস্থায় কোনো শ্রদ্ধাবান কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হতেই পারে না। ভগবান ত্রিবিক্রম প্রত্যেক দলের পাশে প্রবাহিত সেই গঙ্গার জল দিয়ে লোপামুদ্রাকে প্রত্যেক ব্রহ্মগুরুর চোখের পাতার উপর ছিটিয়ে দিতে বললেন।
তার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের কাছে ব্রহ্মগুরুদের চোখের পাতা দেখা গেলেও, সেই চোখের পাতার পিছনের তাঁদের চোখের নড়াচড়া স্পষ্টভাবে দেখা যেতে লাগল।
সেই প্রত্যেক ব্রহ্মগুরুর দুটি চোখ, তাঁদের দুই ভ্রু থেকে সমান দূরত্বে থাকা মধ্যবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল।
আর তাঁদের চোখ থেকে অত্যন্ত পবিত্র ও শুদ্ধ ভাব মৃদু ও নরম বৈদ্যুতিক শক্তির রূপে তাঁদের আজ্ঞাচক্রের দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল।
আর তার সঙ্গে তাঁদের আজ্ঞাচক্রও একটি অসাধারণ সুন্দর তেজে পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছিল।
আর সেই আজ্ঞাচক্র থেকেও একটি অত্যন্ত অসাধারণ প্রবাহ সেই ব্রহ্মগুরুদের চোখের মধ্যে প্রবেশ করছিল।
![]() |
সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ দ্বারা প্রতিপাদিত শ্রীশব্দধ্যানযোগ উপাসনায় থাকা আজ্ঞাচক্র প্রতিমা। |
কিন্তু এই অসাধারণ প্রবাহ জল বা বৈদ্যুতিক শক্তির ছিল না, বরং অত্যন্ত সুন্দর, সৌম্য ও শান্ত এমন আগে কখনো না দেখা এক অদ্ভুত আলোর ছিল।
আর এই অদ্ভুত আলোকরশ্মি সেই ব্রহ্মগুরুদের চোখের মধ্যে ঢুকে তারপর তাঁদের ত্রৈলোক্য দেহের ৭২,০০০ নাড়িতে প্রবাহিত হচ্ছিল।
আর এই আলোর কারণে সেই ব্রহ্মগুরুদের শরীরের প্রতিটি স্থূল কোষ অত্যন্ত তরুণ, উজ্জ্বল ও শুদ্ধ হচ্ছিল এবং তাঁদের মানসিক পদার্থের প্রতিটি কণাও।
এমন সময় সবার কানে ‘ওম শ্রীদত্তগুরবে নমঃ' ভগবান ত্রিবিক্রমের কণ্ঠে মন্ত্র শোনা গেল। আর তার সাথে চোখের পাতার আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছিল সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল।
সকল ব্রহ্মগুরু অবশ্য নিজেদের চোখ খুলতে সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করলেন না - যেন তাঁরা তাঁদের ত্রৈলোক্য দেহে প্রাপ্ত সেই দিব্য আলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করছিলেন।
ভগবান ত্রিবিক্রমের ‘শ্রীদত্তগুরবে নমঃ’ এই জপ চলছিলই। আর তারপর ব্রহ্মর্ষি অগস্ত্য প্রথমে নিজের চোখের পাতা খুললেন। তাঁর পর অন্যান্য সকল ব্রহ্মগুরুরাও ধীরে ধীরে নিজেদের চোখের পাতা খুললেন।
সেই সকল ব্রহ্মর্ষি এবং ব্রহ্মবাদিনীরা এখন আরও তেজস্বী, আরও তরুণ, আরও শক্তিশালী ও বলবান দেখাচ্ছিলেন।
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা হাস্যোজ্জ্বল মুখে সকলকে বললেন, “শ্রীশাম্ভবীমুদ্রার সাধনার কারণে প্রত্যেক সাধকের স্থূল দেহ, প্রাণময় দেহ ও মনোময় দেহ এভাবেই সবসময় নতুন ও সতেজ থাকে।
কিন্তু আজ্ঞাচক্র থেকে যে আলো বের হলো, তা কোথা থেকে এলো, তা শুধু শ্রীশাম্ভবীবিদ্যার সপ্তদশ ও অষ্টাদশ কক্ষেই জানা যায়।
‘সদগুরু ত্ৰিৱিক্রমের কাছ থেকে শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা প্রাপ্ত করা’ এটাই প্রত্যেক শ্রদ্ধাবানের জন্মশৃঙ্খলার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত; কারণ শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা প্রাপ্ত হওয়ার পর দুঃখ, ভয়, ক্লেশ—এই বিষয়গুলো আর পীড়া দেয় না। আর যত বিপদই আসুক না কেন, শ্রদ্ধাবান তা থেকে উদ্ধার হয়ে যায়।
হে উপস্থিত শ্রদ্ধাবানগণ! এই অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী তাঁর অন্যান্য আটটি রূপের মতোই অত্যন্ত কৃপাময়ী।
প্রিয়জনগণ! ‘এই ন’জনের মধ্যে কে বেশি দয়ালু বা কে বেশি শক্তিশালী’ এমনটা ভুল করেও ভাববেন না।
কারণ প্রত্যেকের পথ আলাদা হলেও, প্রত্যেকের প্রেম, কৃপা ও অনুগ্রহ একই রকম।
কারণ শেষ পর্যন্ত এই ন’জন মানে একাই পার্বতী।”
Comments
Post a Comment