![]() |
সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু তাঁর দৈনিক ‘প্রত্যক্ষ’ পত্রিকার ‘তুলসীপত্র’ নামক সম্পাদকীয়র ১৩৯৬ সংখ্যক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, |
সকল উপস্থিতের সামনেই সপ্তমী নবদুর্গা কালরাত্রির রূপান্তর অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরীতে হচ্ছিল।
একেবারে ধীরে ধীরে, অত্যন্ত ধীরে।
এখন পর্যন্ত কোনো রূপান্তরেই (Transformation) এক মুহূর্তও লাগেনি।
কৈলাসে কালের অস্তিত্ব না থাকায়, ‘কতটা ধীরে’ তা কেউ বুঝতে পারছিল না। কিন্তু সেখানকার প্রত্যেকেই ক্রমাগত কোনো না কোনো নিত্যজপ করতে থাকায়, সবারই পূর্ণ জ্ঞান হচ্ছিল যে তাঁদের জপের কত শত আবর্তন হচ্ছে এবং তা সত্ত্বেও এই রূপান্তর চলতেই থাকছে।
সকল উপস্থিতের মধ্যে এ বিষয়ে যে কৌতূহল ছিল তা এখন অস্থিরতায় বদলে যেতে লাগল।
আর ধীরে ধীরে সেই অস্থিরতা মনকে চঞ্চল করতে লাগল। - মহর্ষি থেকে শুরু করে শিবগণ পর্যন্ত প্রত্যেকের মন উৎকণ্ঠার সর্বোচ্চ প্রান্তে পৌঁছে, তারপর সেখান থেকে নিচে পড়ে সম্পূর্ণরূপে অশান্ত ও অস্থির হয়ে গিয়েছিল।
সকল ব্রহ্মর্ষিগণ অবশ্য এই ধীরে ধীরে চলা প্রক্রিয়ার কারণে ক্রমশই শান্ত, তন্ময়, তল্লিত ও আনন্দিত হচ্ছিলেন।
আর এটা বুঝতে পারতেই অন্যদের মনের অশান্তি ও অস্থিরতা আরও দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগল।
নিজের সন্তানদের এই রকম অবস্থা কি আদিমাতা দেখতে পারেন?
নিশ্চিতভাবে না।
আদিমাতা শ্রীবিদ্যা তাঁদের সকলের দিকে কৃপাদৃষ্টিতে দেখে বলতে শুরু করলেন, “হে বৎসগণ! তোমাদের সকলের মন এখন সম্পূর্ণরূপে ‘থর্ব’ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
![]() |
আদিমাতা 'শ্রীবিদ্যা'। |
সাধারণত মানুষ ‘থর্ব’ অবস্থায় যায়, তা তার ষড়রিপুর চরম সীমায় যাওয়ার কারণে।
কিন্তু তোমরা সকলে ‘থর্ব’ অবস্থায় গেছ, তা শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ‘অসতো মা সদ্গময়' এই একটি মাত্র কারণে অর্থাৎ পবিত্র অস্তিত্ব এবং পবিত্র কাজের রহস্য ও কারণ জানতে।
আর তাও কোনো ধরনের স্বার্থের জন্য নয়, শুধু এবং শুধু অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরীকে সম্পূর্ণরূপে জানতে - সম্পূর্ণরূপে সাত্ত্বিক উৎকণ্ঠার কারণে।
হে শিব-ঋষি তুম্বরু! এই রূপান্তর সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তুমি এই সকলকে এই রূপান্তরের কাহিনী বিস্তারিতভাবে শোনাও।”
আদিমাতা শ্রীবিদ্যাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে শিব-ঋষি তুম্বরু গল্প বলা শুরু করলেন, “হে আপ্তজনগণ! এই পার্বতী একবার যখন বসুন্ধরার এবং বসুন্ধরার আকাশ থেকে সেই সময়ে থাকা সমস্ত আসুরী শক্তি, আসুরী রূপ এবং আসুরী গুণকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনই প্রথমবার তাঁর এই ‘কালরাত্রি’ রূপ প্রকাশিত হয়েছিল।
পার্বতী এই সংকল্প কেবল একটি কারণেই করেছিলেন - সেই সময়ে ভগবান পরমশিব ঘনপ্রাণ গণপতির জন্মের জন্য ঘোর তপস্যায় বসেছিলেন।
পরমশিবের এই তপস্যা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন ছিল এবং আসুরী প্রবৃত্তি এর বিরোধিতা করছিল।
এই কারণে এই বিশ্বের ঘনপ্রাণকে জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়ার জন্য মাত্র দশ হাজার বছর সময় বাকি থাকায় এই ভক্তমাতা এমন কঠিন সংকল্প নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলেন এবং তিনি তাঁর সংকল্প মানুষের একশ বছরের মধ্যেই পূরণ করলেন।
আর তার সাথে পরমশিবের তপস্যা মাত্র মানুষের আট বছরে সফল ও সম্পূর্ণ হলো। যার ফলে আদিমাতার প্রয়োজন অনুযায়ী শিবগঙ্গাগৌরীপুত্র বিনায়ক ব্রহ্মণস্পতি ‘গণপতি’ হিসেবে জন্ম নেওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি হয়ে গেল।
![]() |
নবদুর্গা। |
পরমশিব তপস্যা শেষ করে চোখ খুলতেই তিনি পার্বতীর এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখলেন। আর ‘কেবল নিজের জন্যই নিজের প্রিয় সহধর্মিণী নিজের সৌন্দর্য দূরে ফেলে এই ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছেন’ - এটা জেনে পরমশিব তাঁর দিকে অত্যন্ত ভালোবাসা ও স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকালেন।
আর তার সাথে ভর্গলোকে প্রবাহিত গঙ্গা (সপ্তমী গঙ্গা) ভগবান পরমশিবের দুটি চোখ থেকে প্রবাহিত হলো। আর পরমশিব নিজের প্রিয় স্ত্রীকে সেই সপ্তম গঙ্গার জল দিয়ে অভিষেক করতে শুরু করলেন।
স্বয়ং পরমশিব সেই সপ্তম গঙ্গার জল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল নিয়ে পার্বতীর শরীরে লেপন করছিলেন।
আর এমন এক অসাধারণ অভিষেকস্নান ও লেপন মানুষের ১০৮ বছর ধরে চলল।
আর সেই মুহূর্তে পার্বতীর এই অষ্টম নবদুর্গা রূপ ‘মহাগৌরী' প্রকাশিত হলো।”
শিব-ঋষি তুম্বরুর গল্প শেষ হলো। আর সেই মুহূর্তে অষ্টমী নবদুর্গা ‘মহাগৌরী’ তাঁর সম্পূর্ণ ঐশ্বর্য নিয়ে দৃশ্যমান হলেন।
তিনি চতুর্ভুজা ছিলেন। তাঁর ডানদিকের উপরের হাত অভয়মুদ্রায় ছিল, ডানদিকের নিচের হাত ত্রিশূল ধারণ করে ছিল। তাঁর বাঁদিকের উপরের হাতে সৌম্য ও শান্ত ধ্বনি উৎপন্নকারী ডমরু ছিল। আর তাঁর বাঁদিকের নিচের হাতটি বরদমুদ্রায় ছিল।
![]() |
আদিমাতা 'মহাগৌরী'। |
এই মহাগৌরী অসাধারণ গৌর বর্ণের ছিলেন।
তাঁর সমস্ত পোশাকও চন্দ্রের মতো শ্বেতশুভ্র ছিল।
তাঁর সারা শরীরে মুক্তোর অলংকার ছিল এবং গলায় শ্বেত সুগন্ধি ফুলের মালা ছিল।
তাঁর দৃষ্টি পূর্ণ বাৎসল্যে ভরা, সৌম্য, প্রশান্ত ও তৃপ্তিদায়ক ছিল।
তিনি বৃষভ আরোহিণী ছিলেন।
এই বৃষভও সম্পূর্ণ গৌর বর্ণের এবং অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিল।
তাঁর কপালে তৃতীয় নয়ন ছিল না।
মহাগৌরীর চোখের পাতার চুলের নড়াচড়া থেকে অত্যন্ত সুগন্ধি ও শান্তিদানকারী শক্তিপ্রবাহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল।
আর তার স্পর্শ লাগতেই সেখানে উপস্থিত সকলের ‘থর্ব' হয়ে যাওয়া মন সম্পূর্ণরূপে ‘অথর্ব' হয়ে যাচ্ছিল।
---
বাপু এরপর ১৩৯৭ সংখ্যক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন,
আদিমাতা শ্রীবিদ্যা ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রাকে মহাগৌরীর পূজা করার আদেশ দিলেন। সেই অনুযায়ী লোপামুদ্রা অন্যান্য সকল ব্রহ্মবাদিনীসহ সুগন্ধি সাদা ফুল দিয়ে মহাগৌরীর পূজা করলেন।
মহাগৌরী, তাঁকে অর্পণ করা সমস্ত সুগন্ধি সাদা ফুল নিজের অঞ্জলিতে নিয়ে সকলের উপর বর্ষণ করলেন।
আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যেকের হাতে কেবল একটিই শ্বেতপুষ্প মিলল। এবং প্রত্যেকের হাতের সেই শ্বেতপুষ্পটি আটটি পাপড়ির (দলের) ছিল।
এরপর অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী বিভিন্ন রঙের সুগন্ধি ফুল দিয়ে আদিমাতা শ্রীবিদ্যা ও অনসূয়ার পূজা করলেন।
আর মহাগৌরী তাঁর হাতের ফুল আদিমাতার চরণে অর্পণ করতেই, প্রত্যেকের হাতের ‘সেই' শ্বেতপুষ্পটি এখন আরও তেজস্বী ও আনন্দদায়ক দেখাচ্ছিল।
আর সেই অষ্টদলপুষ্পটি প্রত্যেকের ত্রৈলোক্য দেহে শান্তি, প্রসন্নতা, স্থৈর্য, ধৈর্য ও আনন্দ এই গুণগুলি ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি অনুভব করছিলেন যে ‘সেই' অষ্টদলপুষ্প তাঁদের হাতে স্থায়ীভাবে আটকে আছে। আর ‘সেই' পুষ্পটি তাঁদের সম্পূর্ণ মনকে আরও আরও সুন্দর ও শক্তিশালী করছে।

ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা মহাগৌরীর আদেশ অনুযায়ী উপস্থিতের দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, “হে উপস্থিত আপ্তগণ! এই অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী শাম্ভবীবিদ্যার পঞ্চদশ ও ষোড়শ সোপানের (কক্ষের) অধিষ্ঠাত্রী।
এবং নবরাত্রির অষ্টমী তিথির দিন ও রাত্রির নায়িকা।
পরমশিব ভর্গলোকের সপ্তম গঙ্গার জলের লেপন ও অভিষেক করে এই ‘মহাগৌর’ রূপ নির্মাণ করেছেন, এই কথা আমরা শুনেছি।
কিন্তু যদি সপ্তম গঙ্গা থাকে, তবে বাকি ছয়টি গঙ্গার কী হবে? এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।
তবে আপাতত শুধু এতটুকুই মনে রাখতে হবে যে ভূলোকে অবতীর্ণ হওয়া প্রথম গঙ্গা এবং তারপর প্রতিটি লোকের একটি করে গঙ্গা।
বাকি এই গঙ্গাজ্ঞান শাম্ভবী বিদ্যার পঞ্চদশ ও ষোড়শ কক্ষ পার হলেই হয়ে থাকে।
এই সপ্তমী অর্থাৎ ভর্গলোকীয় গঙ্গা ক্ষীরসাগরের জল দিয়েই তৈরি হয়েছে। আর এটিই ‘অমৃতবাহিনী’, ‘অমৃতবর্ষিণী’ ও ‘চন্দ্র মধুপ্রসবিণী’ এই নামগুলিতে পরিচিত।
মহাগৌরী ও ভর্গলোকীয় সপ্তমী গঙ্গা এই দু’জনকে একে অপরের যমজ বোন হিসেবে ধরা হয় - কারণ তাঁদের দুজনের কাজই আসলে যমজ।
শাম্ভবী বিদ্যার পঞ্চদশ ও ষোড়শ সোপানগুলিতে উপাসকদেরকে, নিজেদের গুরুদেবের সামনে বসে, গুরুর নির্দেশনায় ‘শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা’ শিখতে হয়, তার প্রতিদিন তিনবার অভ্যাস করতে হয়, তার অনুশীলন করতে হয় এবং সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
আর এই সব কিছু করান, তিনি অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী।
দেখুন! আমরা প্রথম থেকেই দেখছি যে মহাগৌরীর কপালদেশে তৃতীয় নয়ন নেই। সেখানে কুমকুমের তিলক আছে।
কিন্তু এটি সত্য নয়।
মহাগৌরীরও তৃতীয় নয়ন আছেই।
কিন্তু আমরা কেউই তা দেখতে পারি না।
এমনকি মহর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীরাও না।
এর কারণ কী?
এটিই হলো শ্রীশাম্ভবী মুদ্রার রহস্য। এই মুদ্রা করার সময় উপাসককে নিজের গুরুর আদেশ অনুযায়ী সুখাসনে বসতে হয়। দুটি চোখ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে, তারপর সেই বন্ধ চোখের পাতার পিছনের চোখগুলিকে নিজের আজ্ঞাচক্রের স্থানে অর্থাৎ তৃতীয় নয়ন স্থানে ধীরে ধীরে কেন্দ্রীভূত করতে হয়।
এই ক্রিয়া কতক্ষণ করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, সেই সময়ে মন্ত্র বলতে হবে কি না, কোন মন্ত্র বলতে হবে, কখন মন শান্ত রাখতে হবে এবং কখন মনকে সেই আজ্ঞাচক্রের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হবে ও কীভাবে, এই সব কিছু সদগুরু প্রত্যেক উপাসককে ব্রাহ্মমুহূর্তে পবিত্র নদীর তীরে শেখান।”
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা করা এই শ্রীশাম্ভবী মুদ্রার বর্ণনা শুনে মহর্ষি থেকে শিবগণ পর্যন্ত সকলে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আর প্রত্যেকের মনে ‘আমাদেরকেও এটি পাওয়া উচিত’ এমন ইচ্ছা উৎপন্ন হলো।
আর এমন ইচ্ছা তাঁদের মনে উদয় হতেই ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা বললেন, “অযথা দুঃসাহস করবেন না। আমার বা কারোরই বর্ণনা শুনে হঠাৎ করে চেষ্টা করবেন না।
কারণ এই শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা শ্রীশাম্ভবীবিদ্যার পঞ্চদশ ও ষোড়শ সোপানেই প্রাপ্ত হয় এবং করাও যায়।
এই শ্রীশাম্ভবীমুদ্রা শিব-শক্তির একত্ব, একরূপত্ব ও নিরন্তর সাহচর্য এবং ‘ভেদ থাকা সত্ত্বেও অভেদ’ এমন এক অসাধারণ রূপ ও তার পেছনের রহস্য প্রকাশ করে।
‘আদিমাতাকে ও তাঁরই ‘আদিপিতা’ রূপকে জানা এবং তাঁদের হয়ে থাকা’ এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য এবং এটাই একমাত্র লক্ষ্য এই কক্ষগুলিতে থাকতে হয়।
আর উপস্থিত আপ্তগণ! এত বড় জ্ঞান প্রদানকারী এই মহাগৌরী সাধারণ শ্রদ্ধাবানদেরকে, তাঁদের তাঁদের স্তরে আরও বেশি করে মনঃশান্তি, সবলতা, চিত্তস্থৈর্যতা ও আধ্যাত্মিক প্রগতি দিতেই থাকেন।”
Comments
Post a Comment