সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু তাঁর দৈনিক 'প্রত্যক্ষ'-এর 'তুলসীপত্র' শীর্ষক প্রবন্ধমালার ১৩৮৬ ও ১৩৮৭ নম্বর প্রবন্ধে লেখেন।
ভগবান হয়গ্রীব সেই নববিবাহিত দম্পতির সাথে মার্কণ্ডেয়র আশ্রমের দিকে যাত্রা শুরু করতেই রাজর্ষি শশীভূষণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে লোপামুদ্রাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে জ্যেষ্ঠ ব্রহ্মবাদিনী! এখন এক মাস, এমনকি তারও বেশি সময় ধরে গৌতম ও অহল্যা এখানে থাকবেন না। তাহলে আপনি এরপর যা শেখাবেন, তা থেকে কি তারা বঞ্চিত হবেন? এই প্রশ্ন আমাকে পীড়া দিচ্ছে। আপনি ন্যায়পরায়ণ, এটা জেনেই আমি আপনাকে এই প্রশ্ন করছি।”
লোপামুদ্রা অত্যন্ত কোমলভাবে উত্তর দিলেন, “কন্যার তার স্বামীর সাথে বিদায় দেওয়া এক পিতার অনুভূতি তোমার চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আর তোমার এই বাৎসল্য ভাবের সম্মান রেখেই তোমাকে বলছি - ১) প্রথমত, এরা দু'জনেই মার্কণ্ডেয়র কাছ থেকে শ্রীশাম্ভবীবিদ্যার নবম ও দশম ধাপ বিস্তারিত ও গভীর ভাবে শিখবে। এরপরের সমস্ত শিক্ষাও তারা সেখানেই পাবে এবং সঠিক সময়ে তারা এখানে ফিরেও আসবে। ২) তুমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ভুলে গেছো, আর সেটাও তোমার বাৎসল্যের জন্যই, তাই তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে কৈলাসে নিত্য সময়ই থাকে। এখানে কালের কোনো স্থান নেই।”
রাজর্ষি শশীভূষণ আনন্দে এবং আবেগভরা কণ্ঠে লোপামুদ্রাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং অত্যন্ত শান্তচিত্তে আবার একনিষ্ঠ সাধক হয়ে অধ্যয়নে বসলেন।
লোপামুদ্রা এখন আবার কথা বলা শুরু করলেন, “নবম ও দশম ধাপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘শ্রীললিতা সহস্রনাম' তোমাদের সকলকেও শিখতে হবে। এটি কেবল মুখস্থ করা বা বারবার পাঠ করে যাওয়া প্রকৃত সাধনা নয়। কারণ শ্রীললিতা সহস্রনামের প্রতিটি নাম সহস্রার চক্রের এক বা একাধিক পাপড়িকে সতেজ করা এবং রস যোগানো এক রসনালি। এখানে বসে থাকা প্রত্যেক ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনী সেই পদে তখনই পৌঁছেছেন, যখন এই ললিতা সহস্রনাম এবং তাদের সহস্রার চক্রের মধ্যে এক অনন্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ, যখন মানুষের সহস্রার চক্রের একটি করে দল ললিতা সহস্রনামের একটি করে নামে পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, তখনই ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীর জন্ম হয়।
তাহলে অন্যদের কী হবে? এই প্রশ্ন তোমাদের মনে জাগতে পারে, বরং জাগাই উচিত। কারণ প্রশ্ন ছাড়া চেষ্টা নেই, চেষ্টা ছাড়া উত্তর নেই, আর উত্তর ছাড়া উন্নতি নেই। আর শ্রীশাম্ভবীবিদ্যার নবম ও দশম ধাপ হল প্রত্যেকের ভেতরের আসুরী প্রবৃত্তির সাথে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ। আর কোনো যুদ্ধই ললিতা সহস্রনাম ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ললিতা সহস্রনামের সমর্থন ও আশ্রয়ে যুদ্ধকারী পক্ষ দেবযান পন্থার হয় এবং তারা অবিমিশ্র সাফল্য লাভ করে। আর যদি উভয় পক্ষই ললিতা সহস্রনামের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে, তাহলে স্বয়ং ললিতাম্বিকাই সেই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেন এবং সেই দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা ঘটান। কারণ ‘ললিতাম্বিকা' রূপটিই আসলে যুদ্ধকর্ত্রীও বটে এবং শান্তিকর্ত্রীও বটে। আর সে কারণেই ললিতাম্বিকার ধনু কোনো ধাতু দিয়ে তৈরি হয় না, বরং নিত্যনতুন ইক্ষুদণ্ড (আখ) দিয়ে তৈরি হয় এবং তার তীরগুলো পদ্মকান্ড ও পদ্মকলি দিয়েই তৈরি হয়।
নবদুর্গা স্কন্দমাতা এই ললিতা সহস্রনামের অধ্যয়নের পথপ্রদর্শক এবং ভগবান হয়গ্রীব এই সহস্রনামের সর্বদা গান করতে থাকেন। ভগবান স্কন্দের জন্মের ঠিক এক বছর পর এই স্কন্দমাতা পার্বতী ললিতা সহস্রনাম পাঠ করতে করতে ধ্যানে এতটাই মগ্ন হয়ে গেলেন যে তার আর কোনো জ্ঞান ছিল না। সেই এক বছরের শিশু স্কন্দ, অর্থাৎ কুমার, খেলতে খেলতে হিমালয়ের মণিশিখরে (এভারেস্ট) উপনীত হল, আর সেখান থেকে সে যেন আনন্দে নিচে ঝাঁপ দিতে উদ্যত। তখন সর্বদা জাগ্রত ললিতাম্বিকা তৎক্ষণাৎ মণিশিখরে এসে পৌঁছলেন এবং তিনি নিচে পড়ে যাওয়া কুমার কার্তিকেয়ের ডান হাত শক্ত করে ধরলেন। ঠিক সেই সময়েই অভ্যন্তরীণ বাৎসল্যে জাগ্রত স্কন্দমাতা পার্বতীও তার স্থান থেকে মণিশিখর পর্যন্ত দৌড়ে উঠলেন এবং তিনি নিচে পড়ে যাওয়া কুমার কার্তিকেয়ের বাম হাত ধরলেন।
তাদের দুজনের মনেই একে অপরের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার ভাব ছিল এবং ভবিষ্যতে দেবসেনাপতি হতে চলা কুমার কার্তিকেয়ের উপর অপরিসীম বাৎসল্য ছিল। স্কন্দমাতা পার্বতীর ললিতা সহস্রনামের পাঠ, তিনি জাগ্রত হওয়ার পর, তিনি দৌড়ে চূড়ায় ওঠার সময় এবং কার্তিকেয়কে সামলানোর পরেও চলতে থাকল। এর ফলে সেই ললিতাম্বিকা অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। এখন স্কন্দের ছয়টি মুখেই একসঙ্গে খিদে পেল এবং তা জেনে সেই দু'জনেরই একই সময়ে স্তন থেকে দুধ আসতে লাগল। স্কন্দ কার্তিকেয় সেই দুজনেরই হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন এবং তিনি দুজনেরই স্তনপান করছিলেন। এবং তাকে সম্পূর্ণ স্তনপানের পর ছয়টি মুখ থেকেই ঢেকুর উঠল - সেই ঢেকুর সাধারণ ছিল না, তা ছিল শ্রীললিতা সহস্রনামের প্রাকৃতিক ও সহজ উচ্চারণ। আর এর ফলে সেই ক্ষণের জন্য ললিতাম্বিকা ও স্কন্দমাতা পার্বতী একরূপ হয়ে গেলেন। এবং এরপর যেমন ‘শ্রীযন্ত্র' লক্ষ্মী ও মহালক্ষ্মী উভয়ের একত্র স্থান এবং ‘শ্রীসূক্ত' লক্ষ্মী ও মহালক্ষ্মীর একত্র স্তোত্র, ঠিক তেমনই ‘শ্রীললিতা সহস্রনাম' পার্বতী ও ললিতাম্বিকার একত্র স্তোত্র হয়ে গেল এবং ‘শাম্ভবীবিদ্যা' দুজনের একত্র স্থান নির্ধারিত হল।
বাপু এরপর তুলসীপত্র - ১৩৮৭ নম্বর প্রবন্ধে লেখেন,
এই সমস্ত কাহিনী শুনতে শুনতে সেখানেই বসে থাকা ভগবান স্কন্দের মনে সেই পুরোনো বাৎসল্যের স্মৃতি অত্যন্ত দ্রুত জেগে উঠল এবং তিনি জন্মদাত্রী মাতা পার্বতীর চরণে মাথা রেখে ললিতা সহস্রনাম পাঠ করা শুরু করলেন - আপনা থেকেই এবং সহজভাবে; ঠিক সেই সময়েই রাজর্ষি শশীভূষণের চোখে পার্বতীর স্বাভাবিক ‘চন্দ্রঘণ্টা' রূপের পরিবর্তে ‘স্কন্দমাতা’ রূপটি দেখা যেতে লাগল। শুধু তাই নয়, সেই স্কন্দমাতার আকৃতি অত্যন্ত ধীরে ধীরে বিস্তৃত ও ব্যাপক হতে থাকল এবং এক মুহূর্তে তার মনে হল যে পুরো আকাশ স্কন্দমাতার রূপে ভরে গেছে। এর সাথে সাথে রাজর্ষি শশীভূষণ উঠে দাঁড়ালেন এবং স্বাভাবিকভাবে সেই আকাশব্যাপী স্কন্দমাতার চরণ স্পর্শ করার জন্য সেই চরণের দিকে যেতে লাগলেন।
তিনি যত সেই চরণগুলির কাছে যাচ্ছিলেন, ততই স্কন্দমাতার সেই দুটি চরণ পৃথিবী থেকে উপরে উপরে উঠতে থাকল। এখন সেই সিংহবাহিনী স্কন্দমাতার ডান চরণ পৃথিবীর দিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, কিন্তু তিনি তার বাম পা মুড়ে তার উপর শিশু স্কন্দকে ধারণ করেছিলেন, আর সে কারণেই তার বাম চরণ আড়াআড়ি হওয়া সত্ত্বেও খাড়া ছিল। রাজর্ষি শশীভূষণ সেই ডান চরণটি তার কাছে আরও কাছে থাকা সত্ত্বেও, তার সেই বাম চরণের দিকেই সম্পূর্ণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তার সেই বাম পদপ্রান্তের খাড়া তালুতলে কী দৃশ্য প্রতিভাত হচ্ছিল?
রাজর্ষি শশীভূষণ সম্পূর্ণভাবে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি আনন্দের এক একটি ধাপ উপরে উঠছিলেন এবং এখন তিনি ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্বরে কথা বলতে লাগলেন, “হে স্কন্দমাতা! হে নবদুর্গে! তোমার এই বাম চরণের তালুতে আমি সমস্ত ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীদের তপস্যা দেখতে পাচ্ছি। আর সেই তপস্যা করা ব্রহ্মর্ষিদের চোখের সামনেও আমি আবার কেবল এই তোমার বাম চরণটিই এভাবে দেখছি। আর সেই প্রত্যেক ব্রহ্মর্ষিকে তোমার তালুতে কী দেখা যাচ্ছে, তা অবশ্য আমি জানতে পারিনি - তবে তাদের দুটি চোখই তোমার সেই তালুর দিকে তাকিয়ে বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে, কেবল এটাই আমি দেখতে পাচ্ছি। আহা! তোমার সেই দুই হাতের দুটি কমলপুষ্প এখন সেই ব্রহ্মর্ষিদের মাথায় স্পর্শ করছে। আহা! তোমার সেই দুই হাতের কমলপুষ্প আসলে তোমার ও শিবের সহস্রার চক্র, আর তাদের স্পর্শ হওয়া মাত্রই...”
এতটুকু বলে রাজর্ষি শশীভূষণ মৃত হয়ে গেলেন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দনহীন হয়ে আকাশে ভাসতে লাগলেন। তার ধর্মপত্নী পূর্ণাহুতি অত্যন্ত ভালোবাসা ও অতি আনন্দে আকাশে উড়ে গিয়ে তার স্বামীর দেহের ডান হাতটি হাতে ধরে তাকে ধীরে ধীরে আবার কৈলাসে নামাতে লাগলেন। আর যে মুহূর্তে রাজর্ষি শশীভূষণের পা কৈলাস ভূমিতে স্পর্শ করল, সেই মুহূর্তে তিনি আবার সম্পূর্ণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেন। এবং তার প্রথম নিশ্বাসের সাথে তার সহস্রারচক্রকমল সম্পূর্ণভাবে ফুটে তার মাথা থেকে দশ দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা সকলে দেখতে পেলেন।
কেউ ব্রহ্মর্ষি হচ্ছে, আজ ব্রহ্মর্ষি নন এমন অনেকেই তা দেখছিলেন। আর জ্যেষ্ঠ ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা বলছিলেন, “এখন শশীভূষণ ‘ব্রহ্মর্ষি' হয়েছেন এবং কিছুক্ষণ আগে আমি যে ব্রহ্মর্ষির জন্ম হওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বলেছিলাম, তা আপনারা সবাই এখন দেখলেন।”
‘ব্রহ্মর্ষি শশীভূষণের জয়জয়কার হোক' এমন উদ্দীপক বাণী বলতে বলতে সেখানকার সকল উপস্থিত ব্যক্তি আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। এমনকি শিব, মহাবিষ্ণু, প্রজাপতি ব্রহ্মা, গণপতি, বীরভদ্র, দেবর্ষি নারদ ও শিব-ঋষি তুম্বুরুও এতে শামিল হয়েছিলেন। এবং ব্রহ্মর্ষি শশীভূষণের দুটি চোখ খুলতেই তিনি আদিমাতা শ্রীবিদ্যার চরণে লুটিয়ে পড়লেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে স্কন্দ কার্তিকেয়ের মুখ থেকে ললিতা সহস্রনামের একটি অসাধারণ অদ্ভুত নাম উচ্চারিত হল,
‘ওঁ কল্পনারহিতায়ৈ নমঃ'। আর এই নামের উচ্চারণের সাথে ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা ও নবদুর্গা স্কন্দমাতা স্কন্দের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সেই একই নাম ১০৮ বার উচ্চারণ করলেন।
Comments
Post a Comment