সূত্র - সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক 'প্রত্যক্ষ' পত্রিকার তুলসীপত্র নামক সম্পাদকীয় ধারাবাহিক থেকে সম্পাদকীয় নম্বর ১৩৮৮ ও ১৩৮৯।
সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু তুলসীপত্র - ১৩৮৮ এই সম্পাদকীয়তে লিখেছেন,
ওঁ কল্পনারহিতায়ৈ নমঃ।
এই জপ শেষ করে ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা ব্রহ্মর্ষি অগস্ত্যের কাছ থেকে নবব্রহ্মর্ষি শশিভূষণের গলায় ব্রহ্মর্ষি রুদ্রাক্ষমালা পরিয়ে দিলেন। তার সাথে সাথে ব্রহ্মর্ষি শশিভূষণ দুই হাত জোড় করে আদিমাতার উপস্থিত সমস্ত রূপকে আন্তরিক প্রণাম জানালেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে লোপামুদ্রাকে প্রশ্ন করলেন, 'ওঁ কল্পনারহিতায়ৈ নমঃ' এই শ্রী ললিতাসহস্রনামের মন্ত্রটি এখনো আমার মনে ক্রমাগত ঘুরে চলেছে। এই বিষয়ে তুমি কী তুমি আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলবে?
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা একজন ছোট্ট শিশুর মত শশিভূষণকে কাছে টেনে নিলেন ও বললেন, "হে বৎস! এই নামের অর্থ তুমিই অন্য সবাইকে বলো, এটাই আমার আদেশ। কারণ অন্যদের শেখাতে শেখাতেই মানুষ আরও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে। কারণ অন্যদের সঠিক জ্ঞান দিতে গেলে, সেই প্রকৃত শিক্ষকের তার সমস্ত পূর্বজ্ঞান ও পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হয় এবং তা থেকেই সে প্রকৃত বিদ্বান হয়ে ওঠে। এখন তো তুমি ব্রহ্মর্ষি হয়েছো আর ব্রহ্মর্ষি বা ব্রহ্মবাদিনীর প্রধান কর্তব্য হলো জ্ঞানে বা বিজ্ঞানে ভেজাল ঢুকতে না দেওয়া এবং সাধারণ মানুষের কাছে যতটুকু জ্ঞান প্রয়োজন, তা সহজভাবে পৌঁছে দেওয়া।
ব্রহ্মর্ষি শশিভূষণ কয়েক মুহূর্তের জন্য ধ্যানে গিয়ে নিজে নিশ্চিত হলেন এবং তিনি সমস্ত ঋষি, ঋষিকুমার ও শিবগণকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, "হে সজ্জনগণ! আদিমাতার এই নামটি সত্যিই তার সামর্থ্য, ক্ষমতা, ক্ষমা ও ভালোবাসার প্রকৃত পরিচয় দেয়। আমরা মানুষরা আমাদের বেশিরভাগ জীবন বিভিন্ন কল্পনার মধ্যে বা তার সাহায্যে যাপন করি। কল্পনা কী? তা হলো "পরে কী হবে, কীভাবে কী ঘটবে, যা ঘটে গেছে , তার আমি যা জানি না, তা কীভাবে ঘটেছিল, এই বিষয়ে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের চিন্তা বা তর্ক বা সন্দেহ বা ভয় মানেই কল্পনা।
অনেক সময় আমাদের কর্মফলের প্রত্যাশাই সব কল্পনার মূল জননী হয় এবং তাই ফল পাওয়ার আশা, কল্পনা, তর্ক-বিতর্ক, সন্দেহ ও ভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকে।
কল্পনা করা একেবারেই খারাপ নয়। কিন্তু যে কল্পনার সাথে অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা, অধ্যয়ন ও জ্ঞানের সংযোগ নেই এবং নীতির সীমা নেই, সেই কল্পনা সবসময়ই মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। অনেক সময় মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভুল বোঝাবুঝি এই ধরনের ভুল কল্পনা থেকেই হয়।
প্রতিটি মানুষেরই ফল পাওয়ার আশা থাকবেই; কিন্তু ফল পাওয়ার আশায় কতটা জড়িয়ে পড়তে হবে, সেটা তাকেই ঠিক করতে হয়। কারণ যখন সে ফল পাওয়ার আশার জালে অর্থাৎ কল্পনার রাজ্যে আটকে পড়ে, তখন তার উদ্যমশীলতা দুর্বল হতে থাকে এবং তার কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে।
তাই সনাতন ভারতীয় বৈদিক ধর্ম সবসময় নিষ্কাম কর্মযোগকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ যা কিছু করবে, তার ভালো বা খারাপ ফলাফলের কথা তাকে আগে থেকে ভেবে রাখা উচিত নয়। কারণ এই ধরনের চিন্তা কল্পনা নয়, বরং এই ধরনের চিন্তা হলো বিবেক ও বুদ্ধির স্থৈর্য।
তবে সেই ফলাফলের কথা ভেবে ভীত হয়ে পড়া বা আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়া, এই দুটিই কল্পনারই সন্তান।
এই আমাদের সকলের আদিমাতা একাই এমন যে, তার করা কল্পনা সূক্ষ্ম, অদৃশ্য ও দৃশ্য এই তিন স্তরেই বাস্তবে প্রকাশ পায় - এই ক্ষমতা অন্য কারও নেই এবং মানুষকে যদি তার কৃপা পেতে হয়, তার সান্নিধ্য পেতে হয়, তাহলে তার সম্পর্কে কল্পনা করলে চলবে না।
তাহলে সে কী করবে? এই প্রশ্ন আমাদের মনে আসে। তার উত্তরও খুব সহজ আর তা হলো ১) তার যে রূপটি আমাদের ভালো লাগে, তার ধ্যান করা। ২) তার গুণাবলি অর্থাৎ তার চরিত্র পাঠ করা, আবৃত্তি করা, মনন করা, চিন্তা করা ও তার গুণগান করা এবং ৩) আমাদের সব ফল পাওয়ার আশা তার চরণে উৎসর্গ করা।
হে আমার আপনজনেরা! আমাদের নিজেদের মন যখন সম্পূর্ণভাবে কল্পনাহীন হয়, ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে আমরা তার আঁচল ধরে থাকি।
ব্রহ্মর্ষি শশিভূষণ এতটুকু বলে হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। তার বন্ধ চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু বইছিল। তার চোখের পাতা কাঁপছিল এবং তার সারা শরীরে রোমাঞ্চ জেগেছিল এবং ঠিক সেই মুহূর্তে সদগুরু ভগবান শ্রীত্রিবিক্রম সেখানে আবির্ভূত হলেন এবং তিনি শশিভূষণকে তার কোলে তুলে নিলেন এবং তাকে নিজের কোলে বসিয়ে তার কপালে স্নেহের চুম্বন দিয়ে ত্রিবিক্রম তাকে চোখ খুলতে বললেন।
ব্রহ্মর্ষি শশিভূষণ চোখ খুললেন কিন্তু অবাক হয়ে গেলেন দেখে যে সেখানে উপস্থিত রয়েছেন তখন সব মহর্ষি, ঋষি, ঋষিকুমার ও শিবগণ।
বাপু আবার তুলসীপত্র - ১৩৮৯ এই সম্পাদকীয়তে লিখেছেন,
এমন কী দেখা গিয়েছিল? এমন কী দেখা যাচ্ছিল? আর ঠিক কী ঘটছিল? যার কারণে এরা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল এবং চোখ খোলা অবস্থায় নবব্রহ্মর্ষি শশিভূষণ কিন্তু শান্ত, স্থির ও অত্যন্ত প্রসন্নচিত্ত ছিলেন। তিনি কি এগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন না?
সত্যিই খুব অদ্ভুত কিছু ঘটে যাচ্ছিলো।
ভগবান ত্রিবিক্রমের পিছন থেকে নবদুর্গা স্কন্দমাতা তার সিংহে বসে ও কোলে শিশু স্কন্দকে নিয়ে বাইরে এলেন এবং সবার মাঝখানে এসে থামলেন এবং ঠিক সেই সময়ে আকাশব্যাপী স্কন্দমাতাও সেভাবেই স্থির ছিলেন এবং শুধু তাই নয়, ভগবান ত্রিবিক্রমের শিবনেত্র থেকে (রাম, শিব, হনুমান এঁদের মুখের মধ্যে) থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত সুন্দর সোনালী রঙের আলোতেও স্কন্দমাতাকে দেখা যাচ্ছিল।
তবে আকাশব্যাপী স্কন্দমাতার সিংহ ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র 'বীরভদ্র', সবার মাঝখানে স্থির হওয়া স্কন্দমাতার সিংহ ছিলেন ঘনপ্রাণ শ্রীগণপতি এবং ত্রিবিক্রমের শিবনেত্র থেকে বের হওয়া আলোর ঝলকে স্কন্দমাতার সিংহ ছিলেন স্কন্দ কার্তিকেয়।
সেই তিনটি সিংহ অত্যন্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে নবদুর্গার নয়টি নাম ক্রমানুসারে উচ্চারণ করছিল।
এই ত্রিরূপের সামনে সব ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আন্তরিকভাবে প্রণাম জানালেন এবং দেবর্ষি নারদ ও শিব-ঋষি তুম্বরু শ্রী ললিতাম্বিকে অর্থাৎ আদিমাতা মহাদুর্গার ললিতাসহস্রনাম স্তোত্র গান করতে লাগলেন এবং সেই স্তোত্র শেষ হওয়ার সাথে সাথে স্কন্দমাতার তিনটি রূপ এক মুহূর্তে এক হয়ে আদিমাতা শ্রীবিদ্যার স্বরূপের মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন।
এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একটি উজ্জ্বল তরোয়াল ও একটি সাদা পদ্ম আদিমাতা শ্রীবিদ্যার অভয়হস্ত থেকে বেরিয়ে এলো এবং সেই সাথে ব্রহ্মর্ষি কাত্যায়ন উঠে ব্রহ্মানন্দে নাচতে লাগলেন। অগস্ত্যপুত্র কত এর পুত্র ব্রহ্মর্ষি কাত্য এবং এই ব্রহ্মর্ষি কাত্যের পুত্র কাত্যায়ন।
এই ব্রহ্মর্ষি কাত্যায়ন আদিমাতার 'পরাম্বা' পূজা করে ১০৮ বছর কঠোর তপস্যা করেছিলেন এবং 'পরাম্বা যেন ভগবতী পার্বতীকে নিজের গর্ভে যেন জন্ম দেন এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী পরাম্বার বর অনুসারে কাত্যায়নের স্ত্রী কৃতির গর্ভে ষষ্ঠ নবদুর্গা কাত্যায়নী জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এই কাত্যায়নের ভক্তি সদাসর্বদা বাৎসল্য ও ভক্তিপূর্ণ ছিল এবং এখনও 'সে আমার প্রিয় কন্যা আমার সাথে দেখা করবেই এই আনন্দভাবনায় একজন স্নেহপ্রবণ পিতা হিসেবে নৃত্য করছিলেন। তার নবদুর্গার রূপও তিনি মেনে নিয়েছিলেন। ষষ্ঠ নবদুর্গা হিসেবে তিনি তার চরণে মাথাও রাখতেন এবং তারপর অত্যন্ত স্নেহভরে ভগবতী নবদুর্গা কাত্যায়নীর মাথায় চুম্বনও দিতেন।
ব্রহ্মর্ষি কাত্যায়ন প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে কাত্যায়নীর শিশু রূপের ধ্যান করে পিতৃস্নেহের আনন্দ উপভোগ করতেন। আবার যেমন যেমন দুপুরের সময় এগিয়ে আসত, ঠিক সেই সময় ব্রহ্মর্ষি কাত্যায়ন কাত্যায়নীকে নিজের মাতা হিসেবে তার পুত্রকর্তব্য অনুযায়ী সেবা ও পূজা করতেন, আর দুপুর গড়িয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাত্যায়ন তাকে নিজের পিতামহী (ঠাকুমা) মনে করে তার কাছ থেকে নিজের ছোট্ট শিশুর মতো আদর নিতেন, আর সূর্যাস্তের পর কিন্তু তিনি তাকেই সাক্ষাৎ আদিমাতা ললিতাম্বিকা হিসেবে তার বিশ্বাতীত রূপের অবগাহনে মেতে উঠতেন।
এমন এই বাৎসল্য ও ভক্তির শিরোমণি ব্রহ্মর্ষি কাত্যায়ন সেই তরোয়াল ও পদ্মকে আদর করতে লাগলেন। তখন সেই তরোয়াল ও সেই পদ্ম আপনা থেকেই তার বাম দুটি হাতে ধারণ করে এবং ডান দুটি হাত অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রায় থাকা ষষ্ঠ নবদুর্গা কাত্যায়নী সেখানে আবির্ভূত হলেন।
মুখে তাঁর চাঁদের জ্যোতি আছে কিন্তু তার দাগ নেই, এমন এই নবদুর্গা কাত্যায়নীও সিংহবাহিনী ছিলেন। তবে তার সিংহ একই সাথে পরাক্রম ও প্রসন্নতা এই দুটি ভাবই ধারণ করছিল।
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা হাতে ফুলের সাজিতে ১০৮টি সাদা পদ্ম রেখে দিয়ে এগিয়ে এলেন এবং 'ওঁ কাত্যায়ন্যৈ নমঃ' এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তিনি তার মধ্যে থেকে ১০৭টি পদ্ম নবদুর্গা কাত্যায়নীর চরণে অর্পণ করলেন এবং শেষ ১০৮তম পদ্মটি সেই সিংহের মাথায় অর্পণ করলেন এবং তার সাথে সেই সিংহ দেহের মধ্যে ব্রহ্মর্ষিদের থেকে সাধারণ শ্রদ্ধাবান পর্যন্ত আদিমাতার প্রত্যেক ভক্তকে দেখতে পাওয়া গেল।
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা অত্যন্ত স্নেহভরে বলতে লাগলেন, "এই ষষ্ঠ নবদুর্গা 'কাত্যায়নী' হলেন নবরাত্রির ষষ্ঠী তিথির দিন ও রাতের নায়িকা এবং তিনিই শাম্ভবীবিদ্যার একাদশ ও দ্বাদশ স্তরের অধিষ্ঠাত্রী। এই কাত্যায়নী হলেন ভক্তমাতা পার্বতীর স্নেহভাবের সহজ , সুন্দর ও সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
Comments
Post a Comment