![]() |
সন্দর্ভ - সদ্গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপুর দৈনিক 'প্রত্যক্ষ'-এর 'তুলসীপত্র' শীর্ষক সম্পাদকীয় ধারাবাহিকতার সম্পাদকীয় নং ১৩৮৪ এবং ১৩৮৫। |
সদ্গুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু তুলসীপত্র - ১৩৮৪ সম্পাদকীয়তে লেখেন,
ঋষি গৌতম অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে প্রণাম করে ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রাকে প্রশ্ন করলেন, “হে জ্ঞানদায়িনী মাতা! আমি যখন সূর্যকিরণ এবং সূর্যমণ্ডলের অধ্যয়ন করছিলাম, তখন আমার মাতা কুষ্মাণ্ডার দর্শন হয়েছিল, এবং তাও প্রতিটি সূর্যবিম্বের মাঝখানে। এছাড়াও, আমি তাঁকে এক ব্যাঘ্র (বাঘ) পিঠে আসীন অবস্থায়, সূর্য ও সূর্যসদৃশ নক্ষত্রমণ্ডল অতিক্রম করে ভ্রমণ করতে দেখেছিলাম। এর পেছনের রহস্যটি আপনি কি আমাকে কৃপা করে বলবেন?”
লোপামুদ্রা গৌতমের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “হে শুদ্ধবুদ্ধি গৌতম! তোমার অধ্যয়ন সত্যিই অত্যন্ত সঠিক পথে চলছে এবং তুমি একজন সত্যনিষ্ঠ সাধক।
তোমার এই সত্যনিষ্ঠা-ই মানবজীবনের সব ধরনের অন্ধকার দূর করার সূর্য এবং এই সত্যনিষ্ঠা-ই মাতা কুষ্মাণ্ডার অত্যন্ত প্রিয়, আর তাই তিনি তোমাকে দর্শন দিয়েছেন।
প্রতিটি মানুষের মনে অনেক জায়গায় সত্য জানার তীব্র ইচ্ছা হয় এবং এমন সত্য তার আধ্যাত্মিক অধিকার অনুযায়ী কেবল এই কুষ্মাণ্ডা-ই তাকে উন্মোচন করে দেখান।
এই কুষ্মাণ্ডার হাসি থেকেই সমস্ত সূর্য, তারাদের জন্ম হয়েছে। কারণ তিনিই আদিমাতার মূল প্রকাশিনী শক্তি। এই কারণেই তার নাম 'কাশী’। সমস্ত বিশ্বের সব তারার জ্যোতি একত্র করলেও, তা তাঁর ক্ষুদ্র অংশের দীপ্তির কাছেও ম্লান হয়ে যায়। আর সেই কারণেই সূর্য ও নক্ষত্রলোকের নিকট দিয়ে ভ্রমণ করলেও, তাঁর সামান্যতম কষ্টও হয় না।
বরং, এই বসুন্ধরায় আসা সূর্যের সরাসরি সূর্যকিরণও তিনিই এখানকার জীবনের জন্য সহনীয় করে তোলেন।
আলো ছাড়া নতুন কোনো সৃষ্টি সম্ভব নয়, আর তাঁকে ছাড়া আলোই অস্তিত্ব পায় না। আর এই কারণেই তাঁর আরেক নাম ‘সহস্রপ্রকাশসুন্দরী’।
ব্রহ্মর্ষি কশ্যপ যেই সাধনা করেছিলেন, সেই সাধনার ফলস্বরূপ যে জ্ঞান তিনি তোমাকে দান করেছেন, সেই একই জ্ঞান তিনি তাঁকেও প্রদান করেছিলেন। তাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ব্রহ্মর্ষি কশ্যপ, যাজ্ঞবল্ক্য, বশিষ্ঠ প্রমুখ ব্রহ্মর্ষিদের সঙ্গে নিয়ে এক মহাযজ্ঞের সূচনা করলেন। সেই সময় যজ্ঞকুণ্ড থেকে কুষ্মাণ্ডা স্বয়ং আবির্ভূত হলেন এবং ‘বলি’ প্রার্থনা করলেন।
সমস্ত ব্রহ্মর্ষি স্তব্ধ হয়ে গেলেন, কারণ প্রাণীর বলি তাঁদের আচার-অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাই তাঁরা সকলে আদিমাতা অনসূয়াকে আহ্বান করলেন। তখনই তিনি অষ্টাদশভুজা (আঠারো বাহু বিশিষ্ট) মহামায়ার রূপে আবির্ভূত হলেন এবং নিজেই বললেন “বসুন্ধরার ‘কুষ্মাণ্ড’ অর্থাৎ চালকুমড়োই আমার মূলরূপের জন্য অতি প্রিয় ‘বলি’। সুতরাং তোমরা নির্দ্বিধায় চালকুমড়োই বলি দাও। আমি এখানেই অবস্থান করছি।”
অনসূয়ার কথা অনুযায়ী ব্রহ্মর্ষি কশ্যপ একটি রসাল চালকুমড়োর বলি মাতা কুষ্মাণ্ডাকে দিলেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সমস্ত ব্রহ্মর্ষিরা দেখলেন এবং বুঝলেন যে আদিমাতার প্রতিটি উগ্র রূপকেও চালকুমড়োর বলি-ই শান্ত করে।
সেই যজ্ঞ থেকে প্রকট হওয়া কুষ্মাণ্ডা সেই কুষ্মাণ্ড বলিটিকে প্রেমের সঙ্গে গ্রহণ করে সমস্ত যজ্ঞকারীদের অভয়বচন দিলেন যে 'আদিমাতা এবং আমার প্রতিটি রূপের জন্য চালকুমড়োর বলিদানই সর্বোচ্চ হবে।'
গৌতম! চালকুমড়ো ভালোভাবে অধ্যয়ন কর। এর মধ্যে সূর্যের দাহক উষ্ণতা শোষণ করার অসাধারণ গুণ আছে।
যেকোনো নতুন সৃষ্টি যেমন আলো ছাড়া অসম্ভব, তেমনি 'রস' ছাড়াও অসম্ভব এবং 'রস' ধাতুর অস্তিত্ব জল ছাড়া অসম্ভব।
আর এই কারণেই সেই কুষ্মাণ্ড বলি গ্রহণ করে চতুর্থ নবদুর্গা হিসেবে থাকা কুষ্মাণ্ডা পার্বতী 'স্কন্দমাতা' হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন।
নিজস্ব সূর্যদীপ্ত তেজের সঙ্গে কুষ্মাণ্ডের রস মিশিয়ে তিনি সৌম্যতা ও শীতলতার রূপ ধারণ করলেন। আর সেই কারণেই শিব-পার্বতীর পুত্র ‘স্কন্দ’-এর জন্ম সম্ভব হল।
এই পঞ্চম নবদুর্গা 'স্কন্দমাতা'-ই শম্ভবী বিদ্যার নবম ও দশম কক্ষের, ধাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী
এবং তিনিই নবরাত্রির পঞ্চমী তিথির দিন-রাতের নায়িকা।”
এবার একজন অত্যন্ত তেজস্বী, অনবদ্য রূপবতী ঋষিকুমারী অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ওঠার সময় ব্রহ্মবাদিনী পূর্ণাহুতির অনুমতি নিয়েছিলেন, এটা সবারই নজরে এসেছিল। কিন্তু তিনি কে? তা কারও জানা ছিল না।
সেই তরুণীকে দেখে লোপামুদ্রা অপার মমতার সুরে জিজ্ঞাসা করলেন—
“কন্যা! তোমার প্রশ্ন কী?”
অর্ধোন্মীলিত পলক নিয়ে তরুণী প্রশ্ন করল—
“যিনি সকল সূর্যের তেজ অনায়াসে সহ্য করতে পারেন, সেই পার্বতী দেবী শিবের... (অনুচ্চারিত শব্দ – বীর্য) থেকে সৃষ্ট গর্ভ সহ্য করতে পারলেন না, এ কীভাবে সম্ভব? নিশ্চয়ই এর অন্তরে কোনো পবিত্র ও অতিগোপন রহস্য নিহিত আছে। সেই রহস্যের সন্ধান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার মনে সর্বদা জাগে, আর তার জন্য আমি স্কন্দমাতার আরাধনা করতে চাই। বলুন, আমি কার শরণ নেব?”
তখন ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা স্নেহভরে তাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুম্বন করে বললেন— “হে রাজর্ষি শশিভূষণ ও ব্রহ্মবাদিনী পূর্ণাহুতি! তোমাদের এই কন্যা সত্যিই তার নামের মতোই ‘অ-হল্যা’—অর্থাৎ যে কোনোদিন নষ্ট হয় না।
বাপু আরও তুলসীপত্র - ১৩৮৫ সম্পাদকীয়তে লেখেন,
লোপামুদ্রা অহল্যার সাথে কিছু কথা আস্তে আস্তে বললেন এবং তাকে আবার তার মায়ের পাশে গিয়ে বসতে বললেন এবং তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন, “এই অহল্যা সত্যিই অত্যন্ত চমৎকার ও পবিত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
নবদুর্গা স্কন্দমাতার উপাসনা নারী ও পুরুষ উভয়েই করতে পারে, বৈরাগী ও সাংসারিক উভয়েই করতে পারে, ধনী ও দরিদ্র উভয়েই করতে পারে, জ্ঞানী ও অজ্ঞানী উভয়েই করতে পারে, এতে কোনো প্রশ্নই নেই।
কারণ এই নবদুর্গা স্কন্দমাতা তার পুত্রদের, কন্যাদের পরাক্রম, শৌর্য, রণবিবেক ও আক্রমণাত্মকতার গুণের পাশাপাশি, সঠিক জায়গায় ক্ষমা ও কষ্ট আনন্দের সাথে সহ্য করার ক্ষমতাও দিয়ে থাকেন।
এবং এই সমস্ত গুণের কারণেই বসুন্ধরায় অনেক পবিত্র ও পরাক্রমী রাজা উৎপন্ন হয়েছেন।
![]() |
শ্রীবরদাচণ্ডিকা প্রসন্নোৎসবে আদিমাতা মহাকালী, মহালক্ষ্মী এবং মহাসরস্বতীর পূজা করছেন সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু। |
একইভাবে, ভারতভূমিতে যখনই সনাতন ধর্মের অবক্ষয় শুরু হয় এবং তার পেছনে ‘কুপথগামীদের আক্রমণ’ প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখনই নবদুর্গা স্কন্দমাতা তাঁর কিছু নিষ্ঠাবান ভক্তকে এই সমস্ত দিব্য গুণে সমৃদ্ধ করেন এবং সনাতন বৈদিক ধর্মকে পুনরায় তার শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন।
এখন পর্যন্ত যখনই তার সাধনা করা হয়েছে, তখনই ভারতবর্ষে স্কন্দ কার্তিকেয়ের মতোই চমৎকার সেনাপতি তৈরি হয়েছে।
এখন ভণ্ডাসুরের রূপে শ্যেন প্রদেশে (চীনে) এমনই ভারতবিরোধী অসুরদের উদয় হয়েছে এবং তাই হে অহল্যা! তোমার অধ্যয়ন ও সাধনার কারণে ভণ্ডাসুরের বধের জন্য সঠিক ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতভাবে তৈরি হবে।
শম্ভবী বিদ্যার নবম ও দশম ধাপে, আধ্যাত্মিক সাধনা এবং সংসারেও অনেক বিকাশবিরোধীদের অর্থাৎ উন্নয়নের বিরোধীদের সাথে জোরদার লড়াই করতে হয় এবং তার জন্য আসুরিক প্রবৃত্তিদের সাথে লড়াই করতে শেখা অত্যন্ত জরুরি।
কারণ, আসুরিক প্রবৃত্তিগুলো বৃত্রাসুরের শকুনিদের মাধ্যমে মানুষের মনে প্রবেশ করে বসুন্ধরার আসুরিক শক্তিকে ক্রমশ বৃদ্ধি করে। আর স্কন্দ কার্তিকেয় মানুষের অন্তরের সেই আসুরিক প্রবৃত্তিগুলোকেই সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার দায়িত্ব পালন করেন।
এবং তার জন্য তার নিজের সাধনার প্রয়োজন হয় না, বরং তার প্রয়োজন হয় নবরাত্রি সাধনার এবং আদিমাতার সেই রূপের সাধনার যা জ্ঞানরস দিয়ে তৈরি এবং শৌর্যরস দিয়ে গড়া।
এবং আদিমাতার এই রূপকে 'শ্রীললিতাম্বিকা’ বলা হয়।
পুত্র স্কন্দকে প্রথম স্তন্যপান করানোর সময়েই এই নবদুর্গা স্কন্দমাতা প্রথম 'ললিতাসহস্রনাম' উচ্চারণ করেছিলেন এবং এই কারণেই ললিতাসহস্রনামের পাঠ, অধ্যয়ন, চিন্তন ও মননই শম্ভবীবিদ্যার নবম ও দশম ধাপের প্রধান সাধনা।
হে কন্যা অহল্যা! ভগবান হয়গ্রীব নিজেই মার্কণ্ডেয় ঋষিকে এই ললিতাসহস্রনাম শিখিয়েছেন। তুমি ব্রহ্মর্ষি মার্কণ্ডেয়ের কাছে গিয়ে তার শিষ্যা হও এবং ললিতাসহস্রনামের সাধিকা হও এবং 'বজ্রাদপি কঠোরাণি', 'মৃদুনি কুসুমাদপি' এই সিদ্ধি লাভ কর।
কারণ এই তত্ত্ব দিয়েই নবদুর্গা স্কন্দমাতা পরিপূর্ণ থাকেন।
হে শুদ্ধবুদ্ধি গৌতম! আমার পরামর্শ হল যে তুমি তার সাথেই ব্রহ্মর্ষি মার্কণ্ডেয়ের আশ্রমে যাও।"
লোপামুদ্রার এই পরামর্শ শুনে রাজর্ষি শশিভূষণ কন্যার কথা ভেবে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়লেন—অবিবাহিত ও তরুণী কন্যাকে একইভাবে অবিবাহিত ও তরুণ এক ঋষিকুমারের সঙ্গে দীর্ঘ যাত্রায় পাঠানো তাঁর একেবারেই সঠিক মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ব্রহ্মবাদিনী পূর্ণাহুতি এতে অপরিসীম আনন্দ অনুভব করলেন।
শশিভূষণ যখন তার স্ত্রীর কানে নিজের মনের এই সন্দেহ বললেন, তখন তিনি হাসিমুখে তার কানে বললেন, “আপনি শুধু একটি শব্দ ভুলে যাচ্ছেন - 'অনুরূপ' - পরস্পরের জন্য অনুরূপ।”
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা এই সবকিছু দেখছিলেন এবং বুঝছিলেন। তিনি ঋষি গৌতম এবং ঋষিকন্যা অহল্যাকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং গৌতমের পালকপিতা কশ্যপ এবং অহল্যার মা-বাবাকেও ডাকলেন।
তাদের সবার সম্মতি এল এবং কৈলাসে আনন্দোৎসব ছড়িয়ে পড়ল। কারণ সেখানকার প্রত্যেকের কাছেই এই দম্পতির উপযুক্ততা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য ছিল এবং পছন্দ হয়েছিল।
স্বয়ং ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ ও ব্রহ্মবাদিনী অরুন্ধতী অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সামলালেন।
গৌতম অহল্যার হাত ধরে তার সাথে ব্রহ্মর্ষি মার্কণ্ডেয়ের আশ্রমের দিকে দ্রুত রওনা হলেন।
সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকের মনে হচ্ছিল যে এই নববিবাহিত দম্পতি যেন বিয়ের পর কিছুটা সময় কষ্টহীন এবং সুখ-সুবিধার মধ্যে পায়।
তাদের সবার মনের এই অনুভূতি জেনে ভগবান হয়গ্রীব নিজেই সেখানে প্রকট হলেন এবং আদিমাতাকে প্রণাম করে বললেন, “হে আদিমাতা! আমি এই নববিবাহিত দম্পতিকে আমার পিঠে বসিয়ে মাত্র এক মুহূর্তে মার্কণ্ডেয়ের আশ্রমে নিয়ে যেতে পারি। এর ফলে তাদের ২৯ দিনের ভ্রমণের সময়, তারা বৈবাহিক জীবনের শুরুর জন্য পাবে।”
আদিমাতা আনন্দের সাথে হয়গ্রীবকে অনুমতি দিলেন।
হয়গ্রীব গৌতম ও অহল্যাকে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং হাত জোড় করে আদিমাতাকে প্রশ্ন করলেন, “হে আদিমাতা! সমস্ত ব্রহ্মর্ষি ও মহর্ষি এখানে একত্রিত হলেও কেবল মার্কণ্ডেয় কেন এখনও তার আশ্রমে বসে আছেন?”
আদিমাতা শ্রীবিদ্যা উত্তর দিলেন, “নবব্রহ্মর্ষি মার্কণ্ডেয় তোমারই জন্য অপেক্ষা করছে।”
Comments
Post a Comment