সদগুরু শ্রীঅনিরুদ্ধ বাপু তাঁর 'প্রত্যক্ষ' দৈনিক পত্রিকার তুলসীপত্র নামক সম্পাদকীয় ধারাবাহিক ১৩৯৪ সংখ্যক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন,
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা সপ্তমী নবদুর্গা কালরাত্রির চরণে মাথা রেখে এবং তাঁকে বিনম্রভাবে প্রণাম করে বলতে লাগলেন, হে আপতজনগণ! এই সপ্তমী নবদুর্গা কালরাত্রি শাম্ভবী বিদ্যার ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সোপানের (কক্ষের) অধিষ্ঠাত্রী এবং আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথির দিন ও রাতের নায়িকা।
এই ভগবতী কালরাত্রি ভক্তদের শত্রুদের সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করেন। তাঁর পূজার ফলে ভূত, প্রেত, রাক্ষস, দৈত্য, দানব, তমাচারী তান্ত্রিক এবং পাপী , শত্রু এমনকি সকলেই এক বছর পর্যন্ত সেই পূজক ভক্তের আশেপাশেও ঘেঁষতে পারে না।
সকল শিবগণ হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে দেখতে লাগলেন, আমরা তো পিশাচই। কিন্তু আমাদের তাকে ভয় না পেয়ে বরং তার প্রতি অত্যন্ত ভালোবাসা অনুভব হচ্ছে।
লোপামুদ্রা মৃদু হেসে বললেন, তিনি এমনই। আর আপনারাও শিবগণ, কেবল পিশাচ নন, আর এখন তো আপনাদের রূপও বদলে গেছে।
সকল ঋষি সম্প্রদায় উঠে দাঁড়িয়ে লোপামুদ্রার কাছে অনুরোধ করতে লাগলেন, আমাদেরকে মাঠ , বন, জঙ্গল, গভীর অরণ্য, অনেক শ্মশান ঘাট, এবং ভয়ঙ্কর নরসংহার হওয়া প্রাচীন যুদ্ধভূমি দিয়ে একাকী ভ্রমণ করতে হয়। তাঁর গুণকীর্তন শুনে আমাদের এই নবদুর্গা কালরাত্রির চরণে মাথা রাখার ইচ্ছা হচ্ছে। আমাদের কি সেই অনুমতি মিলবে?
ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা প্রশ্নভরা চোখে ভগবান ত্রিবিক্রমের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মায়ের অনুমতি নিয়ে ভগবান ত্রিবিক্রম আবার তাঁর একমুখী রূপে সকলের সামনে হাজির হলেন এবং তিনি ব্রহ্মবাদিনী অরুন্ধতীকে লোপামুদ্রার হাত নিজের হাতে নিয়ে সকলকে দেখাতে বললেন এবং লোপামুদ্রার মাথার ওড়না সরিয়ে তাঁর কপাল দেখাতে বললেন।
অরুন্ধতী তেমন করতেই সকল মহর্ষি, ঋষিবর এবং ঋষিকুমার অত্যন্ত আশ্চর্য ও কিছুটা ভীত হয়ে গেলেন।
কারণ ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রার মাথা ও হাতে যেখানে যেখানে ভগবতী কালরাত্রির চরণের স্পর্শ হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক বিদ্যুৎ-শলাকা লোপামুদ্রার সহস্রার চক্রে প্রবেশ করে খেলা করছিল এবং তাঁর হাত থেকে অগ্নিশিখার ঢেউ তাঁর শরীরের সমস্ত ৭২,০০০ নাড়িতে প্রবেশ করে আনন্দ নৃত্য করছিল।
এই দেখে মহর্ষিরাও ভীত হয়ে গেলেন। তা দেখে ভগবান ত্রিবিক্রম বললেন, এই কালরাত্রি এমনই। এই শিখা এবং বিদ্যুৎ-শলাকা ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রাকে কোনোভাবেই বেদনা বা কষ্ট দিচ্ছে না, বরং এই বিদ্যুৎলতা ও শিখার কারণে ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রার সহস্রারের সমস্ত সিদ্ধি জাগ্রত হচ্ছে এবং তাঁর দেহের সমস্ত অর্থাৎ ১০৮টি শক্তিকেন্দ্র যেন পবিত্র যজ্ঞকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।
আর এমন তেজ ধারণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে তো সম্ভবই নয়; এমনকি মহর্ষিদের পক্ষেও সম্ভব নয়।
অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরীর রূপ যতই শান্ত ও প্রসন্ন হোক না কেন, তাঁর চরণের প্রত্যক্ষ স্পর্শে মানব দেহের সমস্ত ১০৮ শক্তিকেন্দ্র অত্যন্ত শীতল ও শান্ত হয়ে যায় এবং ৭২,০০০ নাড়ি দিয়ে চন্দ্রতেজ জলপ্রবাহের মতো বইতে থাকে। আর সেই অতিশীতলতাও সাধারণ শ্রদ্ধাবান এবং মহর্ষিরাও সহ্য করতে পারেন না।
নবমী নবদুর্গা সিদ্ধিদাত্রী অত্যন্ত প্রসন্নবদনা। কিন্তু তাঁর মণিদ্বীপমাতার সঙ্গে একাত্মতা রয়েছে।
এই সব কারণে এই তিনজনের প্রতিমার পূজা করা অত্যন্ত সহজ হলেও, তাঁদের প্রত্যক্ষ রূপের ধ্যান করা মহর্ষিদের পক্ষেও সম্ভব হয় না।
কিন্তু এই তিনজনের প্রত্যক্ষ পূজা ও প্রত্যক্ষ ধ্যানের সমস্ত লাভ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের নবরাত্রির পঞ্চমী তিথিতে মাতা ললিতাঅম্বিকার পূজা করলে সহজেই পাওয়া যায়।
কারণ পঞ্চমীর নায়িকা স্কন্দমাতা এবং ললিতাঅম্বিকা সকল শ্রদ্ধাবানদের প্রত্যক্ষ পিতামহী।
এই আদিমাতা ললিতাঅম্বিকা রূপে সবসময় ললিতা পঞ্চমী তিথিতেই প্রকাশিত হন। তখন কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী তাঁর প্রধান সেনাপতি থাকেন।
ললিতাপঞ্চমীর পূজার বর্ণনা করতে আমারও অনেক দিন লাগবে।
এই বলে ভগবান ত্রিবিক্রম কালরাত্রি ও আদিমাতাকে প্রণাম করলেন।
![]() |
শ্রী অনিরুদ্ধগুরুক্ষেত্রমে শ্রীআদিমাতা মহিষাসুরমর্দিনীর দর্শন নিচ্ছেন সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু। |
এবং সেই সময় সেখানে উপস্থিত হলেন সকল নবরূপিণী নবদুর্গা, দশ মহাবিদ্যা, সপ্তমাতৃকা এবং চৌষট্টি কোটি চামুণ্ডা।
এরপর তাঁরা একে একে প্রবেশ করলেন আদিমাতা মহিষাসুরমর্দিনীর প্রতিটি রোমকূপে।
তার সঙ্গে-সঙ্গেই, মণিদ্বীপনিবাসিনী আদিমাতার তৃতীয় নেত্র থেকে একসাথে প্রখর অথচ কোমল এমন এক অপরূপ জ্যোতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
এবং সেই জ্যোতির সঙ্গে সঙ্গে আদিমাতার মূলরূপের স্থানে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেল তাঁর ললিতাম্বিকা-রূপ।
ললিতাম্বিকা প্রকাশিত হতেই সকলকে আশ্বাস দিয়ে বললেন –
“যিনি নবরাত্রির অন্য দিনগুলিতে পূজা করতে পারেন এবং যিনি সেই দিনগুলিতে পূজা করতে পারেন না—উভয়ের জন্যই ললিতাপঞ্চমীর দিনে আমার মহিষাসুরমর্দিনী রূপের, আমার প্রিয় পুত্রসহ, পূজা করা হলে আমি তাদের ভক্তিভাব অনুযায়ী সমগ্র নবরাত্রির পূজার ফল দান করতে সক্ষম।
আর কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী—এই তিন দেবীর চরণে শির নত করার ফলে যে ফল ও আশীর্বাদ লাভ হয়, তা ললিতাপঞ্চমীর দিনে কেবলমাত্র আমাকে ও ত্রিভিক্রমকে বিল্বপাতা অর্পণ করলেই লাভ করা যায়।
কারণ, তোমরা এখনই দেখলে যে সমস্ত নবদুর্গা, সমস্ত সপ্তমাতৃকা, আমার সকল অবতার এবং চৌষট্টি কোটি চামুণ্ডাই আমার মধ্যেই বিরাজমান।”
![]() |
সপ্তমাতৃকা, যাদের পূজা সম্পর্কে সদ্গুরু শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৩-এর প্রবচনে বলেছিলেন। |
বাপু এরপর ১৩৯৫ সংখ্যক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন,
সকল ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীরা অত্যন্ত প্রেম ও আদরের সঙ্গে ললিতাঅম্বিকার 'ললিতাষ্টক স্তোত্র' সামবেদীয় পদ্ধতিতে বলতে শুরু করলেন। এবার তার সঙ্গে সঙ্গে 'ললিতাঅম্বিকা' স্বরূপে 'মণিদ্বীপনিবাসিনী' রূপে আবার বিলীন হয়ে গেল।আর তার সঙ্গে সেই 'মণিদ্বীপনিবাসিনী' আদিমাতাও অদৃশ্য হয়ে 'অষ্টাদশভুজা অনসূয়া' ও 'শ্রীবিদ্যা' এই দুই রূপেই আগের মতোই তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল।
এবার ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রা এগিয়ে এসে , 'কালরাত্রিম্ ব্রহ্মস্তুতাম্ বৈষ্ণবীম্ স্কন্দমাতরম্' এই মন্ত্রটি জপ করতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সপ্তমী নবদুর্গা কালরাত্রি তাঁর চিরপরিচিত রূপে; কিন্তু কোমল তেজযুক্ত হয়ে আবির্ভূত হলেন।
লোপামুদ্রা তাঁকে প্রণাম করে বলতে শুরু করলেন, হে আপতজনগণ! শাম্ভবী বিদ্যার ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সোপানে (কক্ষে), নিজের আধ্যাত্মিক প্রবৃত্তির পথে আসা সকল শত্রুদের বিনাশ করা প্রত্যেক সাধকের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ এমনটা না করলে পবিত্রতার বিরোধী অসুর ও আসুরী প্রবৃত্তির মানুষ সেই সাধকের পরবর্তী পথকে কঠিন করে তোলে।
আর সেই কারণেই সকল ষড়রিপুকে ত্যাগ করা সাধককে, তপস্বীকে এখন পরাক্রমী ও সাহসী বীর ব্যক্তির রূপে কাজ করতে হয় , আর সেই জন্যই এই সপ্তমী নবদুর্গা কালরাত্রি অত্যন্ত সজাগ থাকেন।
কারণ পার্বতীও তাঁর জীবনব্যাপী তপস্যায় 'স্কন্দমাতা' ও 'কাত্যায়নী' এই দুটি কক্ষ্য পার করার পর, কখনও পরমশিবের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এবং অনেক সময় একা একাই আক্ষরিক অর্থে সহস্রাধিক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন আর সেই প্রতিটি অসুরকে তিনি নিশ্চিতভাবে হত্যা করেছেন।
আর সেই সময়ে তাঁর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রকাশিত রূপই হলো সপ্তমী নবদুর্গা 'কালরাত্রি' - যিনি নিজের সন্তানদের রক্ষার জন্য সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকেন।
হে প্রিয় আপতজনগণ! ভালো করে দেখুন। তাঁর চন্দ্রতরবারিতেও ফলার প্রতিটি পাশে একটি করে চোখ আছে।
যখন যখন তাঁর সত্যিকারের শ্রদ্ধাবান ভক্ত তাঁর সাধনভজনে উন্নতি করে, তখন তখন তার সংসার বা আধ্যাত্মিকতার উপর আক্রমণ করতে আসা প্রত্যেকের উপর ভগবতী কালরাত্রির চোখ তাক করা থাকে। আর ঠিক সময়ে এই কালরাত্রি নিজের চন্দ্রতরবারি সেই দুষ্ট ব্যক্তি বা অসুরের উপর ছুঁড়ে মারেন - নিজের স্থান থেকে একচুলও না নড়ে।
কারণ তাঁর চন্দ্রতরবারির দুটি চোখই এই তরবারিকে সঠিকভাবে পথ দেখায় আর সেই অসুর যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, তার চারপাশের সমস্ত সুরক্ষা প্রাচীর ও বাধাকে ভেদ করে এই চন্দ্রতরবারি সেই শ্রদ্ধাবানের শত্রুকে বিনাশ করে।
এবার তাঁর হাতের কন্টকাস্ত্রটি দেখুন। এর সাতটি কন্টক (কাঁটা) আছে। এর মধ্যে ছয়টি কন্টক ছয়টি লোক থেকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পবিত্রতার শত্রুদের অর্থাৎ অসুর ও দৈত্যদের প্রভাব দূর করে।
সত্যি বলতে, আজ পর্যন্ত ষষ্ঠ কন্টকের ব্যবহারই হয়নি। কারণ ষষ্ঠ লোকে অসুররা কখনও প্রবেশই করতে পারেনি।
আর সপ্তম লোকে তো আসুরী প্রবৃত্তিদের প্রবেশ করাও সম্ভব নয়।
তাহলে এই সপ্তম কন্টকের কাজ কী?
এই সপ্তম কন্টক ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সোপানের (কক্ষের মধ্যে) শাম্ভবী বিদ্যার সাধকের জন্য, যা কিছু তার হৃদয়ে খোদাই করার আছে - ভাব, শব্দ, ধ্যান, চিত্র, ঘটনা, অভিজ্ঞতা, স্তোত্র, মন্ত্র, নাম -
![]() |
আদিমাতা মহিষাসুরমর্দিনী এবং শ্রীঅনিরুদ্ধগুরুক্ষেত্রমের ধর্মাসনে অধিষ্ঠিত সদ্গুরু
শ্রী অনিরুদ্ধ বাপু। |
সেই সব খোদাই করার জন্য ভগবতী কালরাত্রির কাছ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ লিখন ও সাধন আছে তা এই সপ্তম কন্টক যখন শ্রদ্ধাবানের প্রাপ্ত হয়, তখনই স্বয়ং ভগবান ত্রিবিক্রম, সাধককে যা যা লেখার প্রয়োজন তা লিখে ফেলার পর, সেই সাধককে শাম্ভবী বিদ্যার মন্ত্র স্বয়ং প্রদান করেন।
আর এখানে সেই শ্রদ্ধাবান সাধককে মাতা কালরাত্রি মহাগৌরী রূপ ধারণ করে তাঁকে শাম্ভবী ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
হে গৌতম ও অহল্যা, আসুন। আপনাদের স্বাগত। আপনারা এখান পর্যন্ত সব কিছু শিখে এসেছেন।
সকল ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদিনীরা অন্যান্য সকল উপস্থিতদের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে গৌতম-অহল্যাকে প্রেমসহকারে স্বাগত জানালেন।
আর লোপামুদ্রা আগে বলতে লাগলেন, "কালরাত্রির উগ্র এবং তবুও অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্রেমে ভরা রূপ থেকে অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরীর কাছে যাওয়া মানে অত্যন্ত উগ্র ও দাহক তেজ থেকে অত্যন্ত সৌম্য, শীতল তেজ পর্যন্তেরই প্রবাস।
অর্থাৎ বিশ্বের দুটি মেরুর জ্ঞান।"
এবার সপ্তমী নবদুর্গা কালরাত্রিই ধীরে ধীরে অষ্টমী নবদুর্গা মহাগৌরী হয়ে উঠতে লাগলেন।
গৌতম ও অহল্যা ভগবতী কালরাত্রির স্তুতি করে তাঁর কাছ থেকে অত্যন্ত প্রেমসহকারে বিদায় নিচ্ছিলেন।
কিন্তু ভগবতী কালরাত্রি তাঁর অঙ্গুষ্ঠমাত্র রূপ ব্রহ্মর্ষি গৌতমের হৃদয়ে স্থাপন করলেন।
Comments
Post a Comment